ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে আমার পোষা হরিণে বাছুরে যেমন ভাব তেমনি ভাব শালবনে আর মহুয়ায়। ওদের পাতা ঝরছে গাছের তলায়, উড়ে পড়ছে আমার জানলাতে। তালগাছটা খাড়া দাঁড়িয়ে পুবের দিকে, সকালবেলাকার বাঁকা রোদ্দুর তারি চোরাই ছায়া ফেলে আমার দেয়ালে। নদীর ধারে ধারে পায়ে-চলা পথ রাঙা মাটির উপর দিয়ে, কুড়চির ফুল ঝরে তার ধুলোয়; বাতাবি-লেবু-ফুলের গন্ধ ঘনিয়ে ধরে বাতাসকে; জারুল পলাশ মাদারে চলেছে রেষারেষি; শজনে ফুলের ঝুরি দুলছে হাওয়ায়; চামেলি লতিয়ে গেছে বেড়ার গায়ে গায়ে ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে। নদীতে নেমেছে ছোটো একটি ঘাট লাল পাথরে বাঁধানো। তারি এক পাশে অনেক কালের চাঁপাগাছ, মোটা তার গুঁড়ি। নদীর উপরে বেঁধেছি একটি সাঁকো, তার দুই পাশে কাঁচের টবে জুঁই বেল রজনীগন্ধা শ্বেতকরবী। গভীর জল মাঝে মাঝে, নীচে দেখা যায় নুড়িগুলি। সেইখানে ভাসে রাজহংস আর ঢালুতটে চরে বেড়ায় আমার পাটল রঙের গাই গোরুটি আর মিশোল রঙের বাছুর ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে। ঘরের মেঝেতে ফিকে নীল রঙের জাজিম পাতা খয়েরিরঙের-ফুল-কাটা। দেয়াল বাসন্তী রঙের, তাতে ঘন কালো রেখার পাড়। একটুখানি বারান্দা পুবের দিকে, সেইখানে বসি সূর্যোদয়ের আগেই। একটি মানুষ পেয়েছি তার গলায় সুর ওঠে ঝলক দিয়ে, নটীর কঙ্কণে আলোর মতো। পাশের কুটিরে সে থাকে, তার চালে উঠেছে ঝুম্কোলতা। আপন মনে সে গায় যখন তখনি পাই শুনতে-- গাইতে বলি নে তাকে। স্বামীটি তার লোক ভালো-- আমার লেখা ভালোবাসে, ঠাট্টা করলে যথাস্থানে যথোচিত হাসতে জানে, খুব সাধারণ কথা সহজেই পারে কইতে, আবার হঠাৎ কোনো-একদিন আলাপ করে --লোকে যাকে চোখ টিপে বলে কবিত্ব-- রাত্রি এগারোটার সময় শালবনে ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে। বাড়ির পিছন দিকটাতে শাক-সবজির খেত। বিঘে-দুয়েক জমিতে হয় ধান। আর আছে আম-কাঁঠালের বাগিচা আস্শেওড়ার-বেড়া-দেওয়া। সকালবেলায় আমার প্রতিবেশিনী গুন্ গুন্ গাইতে গাইতে মাখন তোলে দই থেকে, তার স্বামী যায় দেখতে খেতের কাজ লাল টাট্টু ঘোড়ায় চ'ড়ে। নদীর ও পারে রাস্তা, রাস্তা ছাড়িয়ে ঘন বন-- সে দিক থেকে শোনা যায় সাঁওতালের বাঁশি আর শীতকালে সেখানে বেদেরা করে বাসা ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে। এই পর্যন্ত। এ বাসা আমার হয় নি বাঁধা, হবেও না। ময়ূরাক্ষী নদী দেখিও নি কোনো দিন। ওর নামটা শুনি নে কান দিয়ে, নামটা দেখি চোখের উপরে-- মনে হয় যেন ঘননীল মায়ার অঞ্জন লাগে চোখের পাতায়। আর মনে হয় আমার মন বসবে না আর কোথাও, সব কিছু থেকে ছুটি নিয়ে চলে যেতে চায় উদাস প্রাণ ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে।
THOU HAST made me endless, such is thy pleasure. This frail vessel thou emptiest again and again, and finest it ever with fresh life. This little flute of a reed thou hast carried over hills and dales, and hast breathed through it melodies eternally new. At the immortal touch of thy hands my little heart loses its limits in joy and gives birth to utterance ineffable. Thy infinite gifts come to me only on these very small hands of mine. Ages pass, and still thou pourest, and still there is room to fill.
শীতের রোদ্দুর। সোনা-মেশা সবুজের ঢেউ স্তম্ভিত হয়ে আছে সেগুন বনে। বেগনি-ছায়ার ছোঁওয়া-লাগা ঝুরি-নামা বৃদ্ধ বট ডাল মেলেছে রাস্তার ওপার পর্যন্ত। ফলসাগাছের ঝরা পাতা হঠাৎ হাওয়ায় চমকে বেড়ায় উড়ে ধুলোর সাঙাত হয়ে। কাজ-ভোলা এই দিন উধাও বলাকার মতো লীন হয়ে চলেছে নিঃসীম নীলিমায়। ঝাউগাছের মর্মরধ্বনিতে মিশে মনের মধ্যে এই কথাটি উঠছে বেজে, "আমি আছি।" কুয়োতলার কাছে সামান্য ঐ আমের গাছ; সারা বছর ও থাকে আত্মবিস্মৃত, বনের সাধারণ সবুজের আবরণে ও থাকে ঢাকা। এমন সময় মাঘের শেষে হঠাৎ মাটির নিচে শিকড়ে শিকড়ে তার শিহর লাগে, শাখায় শাখায় মুকুলিত হয়ে ওঠে বাণী-- "আমি আছি," চন্দ্রসূর্যের আলো আপন ভাষায় স্বীকার করে তার সেই ভাষা। অলস মনের শিয়রে দাঁড়িয়ে হাসেন অন্তর্যামী, হঠাৎ দেন ঠেকিয়ে সোনার কাঠি প্রিয়ার মুগ্ধ চোখের দৃষ্টি দিয়ে, কবির গানের সুর দিয়ে, তখন যে-আমি ধূলিধূসর সামান্য দিনগুলির মধ্যে মিলিয়ে ছিল, সে দেখা দেয় এক নিমেষের অসমান্য আলোকে। সে-সব দুর্মূল্য নিমেষ কোনো রত্নভাণ্ডারে থেকে যায় কি না জানিনে; এইটুকু জানি-- তারা এসেছে আমার আত্মবিস্মৃতির মধ্যে, জাগিয়েছে আমার মর্মে বিশ্বমর্মের নিত্যকালের সেই বাণী "আমি আছি।"