শত শত লোক চলে শত শত পথে। তারি মাঝে কোথা কোন্ রথে সে আসিছে যার আজি নব অভ্যুদয়। দিক্লক্ষ্মী গাহিল না জয়; আজও রাজটিকা ললাটে হল না তার লিখা। নাই অস্ত্র, নাই সৈন্যদল, অস্ফুট তাহার বাণী, কণ্ঠে নাহি বল। সে কি নিজে জানে আসিছে সে কী লাগিয়া, আসে কোন্খানে! যুগের প্রচ্ছন্ন আশা করিছে রচনা তার অভ্যর্থনা কোন্ ভবিষ্যতে-- কোন্ অলক্ষিত পথে আসিতেছে অর্ঘ্যভার! আকাশে ধ্বনিছে বারম্বার-- "মুখ তোলো, আবরণ খোলো হে বিজয়ী, হে নির্ভীক, হে মহাপথিক-- তোমার চরণক্ষেপ পথে পথে দিকে দিকে মুক্তির সংকেতচিহ্ন যাক লিখে লিখে।'
স্থির জেনেছিলেম, পেয়েছি তোমাকে, মনেও হয়নি তোমার দানের মূল্য যাচাই করার কথা। তুমিও মূল্য করনি দাবি। দিনের পর দিন গেল, রাতের পর রাত, দিলে ডালি উজাড় ক'রে। আড়চোখে চেয়ে আনমনে নিলেম তা ভাণ্ডারে; পরদিনে মনে রইল না। নববসন্তের মাধবী যোগ দিয়েছিল তোমার দানের সঙ্গে, শরতের পূর্ণিমা দিয়েছিল তারে স্পর্শ। তোমার কালো চুলের বন্যায় আমার দুই পা ঢেকে দিয়ে বলেছিলে "তোমাকে যা দিই তোমার রাজকর তার চেয়ে অনেক বেশি; আরো দেওয়া হল না আরো যে আমার নেই।" বলতে বলতে তোমার চোখ এল ছলছলিয়ে। আজ তুমি গেছ চলে, দিনের পর দিন আসে, রাতের পর রাত, তুমি আস না। এতদিন পরে ভাণ্ডার খুলে দেখছি তোমার রত্নমালা, নিয়েছি তুলে বুকে। যে গর্ব আমার ছিল উদাসীন সে নুয়ে পড়েছে সেই মাটিতে যেখানে তোমার দুটি পায়ের চিহ্ন আছে আঁকা। তোমার প্রেমের দাম দেওয়া হল বেদনায়, হারিয়ে তাই পেলেম তোমায় পূর্ণ ক'রে।
ফুরিয়ে গেল পৌষের দিন; কৌতূহলী ভোরের আলো কুয়াশার আবরণ দিলে সরিয়ে। হঠাৎ দেখি শিশিরে-ভেজা বাতাবি গাছে ধরেছে কচি পাতা; সে যেন আপনি বিস্মিত। একদিন তমসার কূলে বাল্মীকি আপনার প্রথম নিশ্বসিত ছন্দে চকিত হয়েছিলেন নিজে,-- তেমনি দেখলেম ওকে। অনেকদিনকার নিঃশব্দ অবহেলা থেকে অরুণ-আলোতে অকুণ্ঠিত বাণী এনেছে এই কয়টি কিশলয়; সে যেন সেই একটুখানি কথা তুমিই বলতে পারতে, কিন্তু না ব'লে গিয়েছ চলে। সেদিন বসন্ত ছিল অনতিদূরে; তোমার আমার মাঝখানে ছিল আধ-চেনার যবনিকা কেঁপে উঠল সেটা মাঝে মাঝে; মাঝে মাঝে তার একটা কোণ গেল উড়ে; দুরন্ত হয়ে উঠল দক্ষিণ বাতাস, তবু সরাতে পারেনি অন্তরাল। উচ্ছৃঙ্খল অবকাশ ঘটল না; ঘণ্টা গেল বেজে, সায়াহ্নে তুমি চলে গেলে অব্যক্তের অনালোকে।