৩ ভাদ্র, ১৩৩৯


 

বাসা (basa)


ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে

         আমার পোষা হরিণে বাছুরে যেমন ভাব

             তেমনি ভাব শালবনে আর মহুয়ায়।

         ওদের পাতা ঝরছে গাছের তলায়,

             উড়ে পড়ছে আমার জানলাতে।

         তালগাছটা খাড়া দাঁড়িয়ে পুবের দিকে,

             সকালবেলাকার বাঁকা রোদ্‌দুর

তারি চোরাই ছায়া ফেলে আমার দেয়ালে।

      নদীর ধারে ধারে পায়ে-চলা পথ

             রাঙা মাটির উপর দিয়ে,

         কুড়চির ফুল ঝরে তার ধুলোয়;

      বাতাবি-লেবু-ফুলের গন্ধ

         ঘনিয়ে ধরে বাতাসকে;

      জারুল পলাশ মাদারে চলেছে রেষারেষি;

         শজনে ফুলের ঝুরি দুলছে হাওয়ায়;

      চামেলি লতিয়ে গেছে বেড়ার গায়ে গায়ে

             ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে।

      নদীতে নেমেছে ছোটো একটি ঘাট

             লাল পাথরে বাঁধানো।

      তারি এক পাশে অনেক কালের চাঁপাগাছ,

             মোটা তার গুঁড়ি।

      নদীর উপরে বেঁধেছি একটি সাঁকো,

         তার দুই পাশে কাঁচের টবে

             জুঁই বেল রজনীগন্ধা শ্বেতকরবী।

                 গভীর জল মাঝে মাঝে,

             নীচে দেখা যায় নুড়িগুলি।

         সেইখানে ভাসে রাজহংস

             আর ঢালুতটে চরে বেড়ায়

আমার পাটল রঙের গাই গোরুটি

      আর মিশোল রঙের বাছুর

             ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে।

 

ঘরের মেঝেতে ফিকে নীল রঙের জাজিম পাতা

             খয়েরিরঙের-ফুল-কাটা।

      দেয়াল বাসন্তী রঙের,

             তাতে ঘন কালো রেখার পাড়।

      একটুখানি বারান্দা পুবের দিকে,

             সেইখানে বসি সূর্যোদয়ের আগেই।

      একটি মানুষ পেয়েছি

তার গলায় সুর ওঠে ঝলক দিয়ে,

         নটীর কঙ্কণে আলোর মতো।

             পাশের কুটিরে সে থাকে,

তার চালে উঠেছে ঝুম্‌কোলতা।

        আপন মনে সে গায় যখন

           তখনি পাই শুনতে--

               গাইতে বলি নে তাকে।

স্বামীটি তার লোক ভালো--

           আমার লেখা ভালোবাসে, ঠাট্টা করলে

        যথাস্থানে যথোচিত হাসতে জানে,

খুব সাধারণ কথা সহজেই পারে কইতে,

    আবার হঠাৎ কোনো-একদিন আলাপ করে

        --লোকে যাকে চোখ টিপে বলে কবিত্ব--

           রাত্রি এগারোটার সময় শালবনে

               ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে।

 

বাড়ির পিছন দিকটাতে

         শাক-সবজির খেত।

বিঘে-দুয়েক জমিতে হয় ধান।

      আর আছে আম-কাঁঠালের বাগিচা

         আস্‌শেওড়ার-বেড়া-দেওয়া।

      সকালবেলায় আমার প্রতিবেশিনী

         গুন্‌ গুন্‌ গাইতে গাইতে মাখন তোলে দই থেকে,

      তার স্বামী যায় দেখতে খেতের কাজ

             লাল টাট্টু ঘোড়ায় চ'ড়ে।

      নদীর ও পারে রাস্তা,

             রাস্তা ছাড়িয়ে ঘন বন--

সে দিক থেকে শোনা যায় সাঁওতালের বাঁশি

      আর শীতকালে সেখানে বেদেরা করে বাসা

             ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে।

 

      এই পর্যন্ত।

এ বাসা আমার হয় নি বাঁধা, হবেও না।

         ময়ূরাক্ষী নদী দেখিও নি কোনো দিন।

             ওর নামটা শুনি নে কান দিয়ে,

                 নামটা দেখি চোখের উপরে--

             মনে হয় যেন ঘননীল মায়ার অঞ্জন

                     লাগে চোখের পাতায়।

আর মনে হয়

      আমার মন বসবে না আর কোথাও,

         সব কিছু থেকে ছুটি নিয়ে

             চলে যেতে চায় উদাস প্রাণ

                 ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে।

 

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •