কালো অন্ধকারের তলায় পাখির শেষ গান গিয়েছে ডুবে। বাতাস থমথমে, গাছের পাতা নড়ে না, স্বচ্ছরাত্রের তারাগুলি যেন নেমে আসছে পুরাতন মহানিম গাছের ঝিল্লি-ঝংকৃত স্তব্ধ রহস্যের কাছাকাছি। এমন সময়ে হঠাৎ আবেগে আমার হাত ধরলে চেপে; বললে, "তোমাকে ভুলব না কোনোদিনই।" দীপহীন বাতায়নে আমার মূর্তি ছিল অস্পষ্ট, সেই ছায়ার আবরণে তোমার অন্তরতম আবেদনের সংকোচ গিয়েছিল কেটে। সেই মুহূর্তে তোমার প্রেমের অমরাবতী ব্যাপ্ত হল অনন্ত স্মৃতির ভূমিকায়। সেই মুহূর্তের আনন্দবেদনা বেজে উঠল কালের বীণায়, প্রসারিত হল আগামী জন্মজন্মান্তরে। সেই মুহূর্তে আমার আমি তোমার নিবিড় অনুভবের মধ্যে পেল নিঃসীমতা। তোমার কম্পিত কণ্ঠের বাণীটুকুতে সার্থক হয়েছে আমার প্রাণের সাধনা, সে পেয়েছে অমৃত। তোমার সংসারে অসংখ্য যা-কিছু আছে তার সবচেয়ে অত্যন্ত ক'রে আছি আমি, অত্যন্ত বেঁচে। এই নিমেষটুকুর বাইরে আর যা-কিছু সে গৌণ। এর বাইরে আছে মরণ, একদিন রূপের আলো-জ্বালা রঙ্গমঞ্চ থেকে সরে যাব নেপথ্যে। প্রত্যক্ষ সুখদুঃখের জগতে মূর্তিমান অসংখ্যতার কাছে আমার স্মরণচ্ছায়া মানবে পরাভব। তোমার দ্বারের কাছে আছে যে কৃষ্ণচূড়া যার তলায় দুবেলা জল দাও আপন হাতে, সেও প্রধান হয়ে উঠে' তার ডালপালার বাইরে সরিয়ে রাখবে আমাকে বিশ্বের বিরাট অগোচরে। তা হোক, এও গৌণ।
নদীর প্রবাহের এক ধারে সামান্য একটা ভাঙা ডাল আটকা পড়েছিল। সেইটেতে ঘোলা জল থেকে পলি ছেঁকে নিতে লাগল। সেইখানে ক্রমে একটা দ্বীপ জমিয়ে তুললে। ভেসে-আসা নানা-কিছু অবান্তর জিনিস দল বাঁধল সেখানে, শৈবাল ঘন হয়ে সেখানে ঠেকল এসে , মাছ পেল আশ্রয়, এক পায়ে বক রইল দাঁড়িয়ে শিকারের লোভে, খানিকটুকু সীমানা নিয়ে একটা অভাবিত দৃশ্য জেগে উঠল--তার সঙ্গে চার দিকের বিশেষ মিল নেই। চৈতালি তেমনি এক-টুকরো কাব্য যা অপ্রত্যাশিত। স্রোত চলছিল যে রূপ নিয়ে অল্প-কিছু বাইরের জিনিসের সঞ্চয় জ'মে ক্ষণকালের জন্যে তার মধ্যে আকস্মিকের আবির্ভাব হল। পতিসরের নাগর নদী নিতান্তই গ্রাম্য। অল্প তার পরিসর, মন্থর তার স্রোত। তার এক তীরে দরিদ্র লোকালয়, গোয়ালঘর, ধানের মরাই, বিচালির স্তূপ; অন্য তীরে বিস্তীর্ণ ফসল-কাটা শস্যখেত ধূ ধূ করছে। কোনো-এক গ্রীষ্মকাল এইখানে আমি বোট বেঁধে কাটিয়েছি। দুঃসহ গরম। মন দিয়ে বই পড়বার মতো অবস্থা নয়। বোটের জানালা বন্ধ করে খড়খড়ি খুলে সেই ফাঁকে দেখছি বাইরের দিকে চেয়ে। মনটা আছে ক্যামেরার চোখ নিয়ে, ছোটো ছোটো ছবির ছায়া ছাপ দিচ্ছে অন্তরে। অল্প পরিধির মধ্যে দেখছি বলেই এত স্পষ্ট করে দেখছি। সেই স্পষ্ট দেখার স্মৃতিকে ভরে রাখছিলুম নিরলংকৃত ভাষায়। অলংকার-প্রয়োগের চেষ্টা জাগে মনে যখন প্রত্যক্ষবোধের স্পষ্টতা সম্বন্ধে সংশয় থাকে। যেটা দেখছি মন যখন বলে, "এটাই যথেষ্ট' তখন তার উপরে রঙ লাগাবার ইচ্ছাই থাকে না। চৈতালীর ভাষা সহজ হয়েছে এইজন্যেই। তুমি যদি বক্ষোমাঝে থাক নিরবধি, তোমার আনন্দমূর্তি নিত্য হেরে যদি এ মুগ্ধ নয়ন মোর,--পরাণ-বল্লভ, তোমার কোমলকান্ত চরণ পল্লব চিরস্পর্শ রেখে দেয় জীবন তরীতে,-- কোনো ভয় নাহি করি বাঁচিতে মরিতে।