আধবুড়ো হিন্দুস্থানি, রোগা লম্বা মানুষ-- পাকা গোঁফ, দাড়ি-কামানো মুখ শুকিয়ে-আসা ফলের মতো। ছিটের মের্জাই গায়ে, মালকোঁচা ধুতি, বাঁ কাঁধে ছাতি, ডান হাতে খাটো লাঠি, পায়ে নাগরা-- চলেছে শহরের দিকে। ভাদ্রমাসের সকালবেলা, পাতলা মেঘের ঝাপসা রোদ্দুর; কাল গিয়েছে কম্বল-চাপা হাঁপিয়ে-ওঠা রাত, আজ সকালে কুয়াশা-ভিজে হাওয়া দোমনা ক'রে বইছে আমলকীর কচি ডালে। পথিকটিকে দেখা গেল আমার বিশ্বের শেষরেখাতে যেখানে বস্তুহারা ছায়াছবির চলাচল। ওকে শুধু জানলুম একজন লোক। ওর নাম নেই, সংজ্ঞা নেই, বেদনা নেই, কিছুতে নেই কোনো দরকার-- কেবল হাটে-চলার পথে ভাদ্রমাসের সকালবেলায় একজন লোক। সেও আমায় গেছে দেখে তার জগতের পোড়ো জমির শেষ সীমানায়, যেখানকার নীল কুয়াশার মাঝে কারো সঙ্গে সম্বন্ধ নেই কারো, যেখানে আমি-- একজন লোক। তার ঘরে তার বাছুর আছে, ময়না আছে খাঁচায়; স্ত্রী আছে তার, জাঁতায় আটা ভাঙে, পিতলের মোটা কাঁকন হাতে; আছে তার ধোবা প্রতিবেশী, আছে মুদি দোকানদার দেনা আছে কাবুলিদের কাছে; কোনোখানেই নেই আমি-- একজন লোক।
খোকার চোখে যে ঘুম আসে সকল-তাপ-নাশা-- জান কি কেউ কোথা হতে যে করে সে যাওয়া-আসা। শুনেছি রূপকথার গাঁয়ে জোনাকি-জ্বলা বনের ছায়ে দুলিছে দুটি পারুল-কুঁড়ি, তাহারি মাঝে বাসা-- সেখান থেকে খোকার চোখে করে সে যাওয়া-আসা। খোকার ঠোঁটে যে হাসিখানি চমকে ঘুমঘোরে-- কোন্ দেশে যে জনম তার কে কবে তাহা মোরে। শুনেছি কোন্ শরৎ-মেঘে শিশু-শশীর কিরণ লেগে সে হাসিরুচি জনমি ছিল শিশিরশুচি ভোরে-- খোকার ঠোঁটে যে হাসিখানি চমকে ঘুমঘোরে। খোকার গায়ে মিলিয়ে আছে যে কচি কোমলতা-- জান কি সে যে এতটা কাল লুকিয়ে ছিল কোথা। মা যবে ছিল কিশোরী মেয়ে করুণ তারি পরান ছেয়ে মাধুরীরূপে মুরছি ছিল কহে নি কোনো কথা-- খোকার গায়ে মিলিয়ে আছে যে কচি কোমলতা। আশিস আসি পরশ করে খোকারে ঘিরে ঘিরে-- জান কি কেহ কোথা হতে সে বরষে তার শিরে। ফাগুনে নব মলয়শ্বাসে, শ্রাবণে নব নীপের বাসে, আশিনে নব ধান্যদলে, আষাড়ে নব নীরে-- আশিস আসি পরশ করে খোকারে ঘিরে ঘিরে।
এই-যে খোকা তরুণতনু নতুন মেলে আঁখি-- ইহার ভার কে লবে আজি তোমরা জান তা কি। হিরণময় কিরণ-ঝোলা যাঁহার এই ভুবন-দোলা তপন-শশী-তারার কোলে দেবেন এরে রাখি-- এই-যে খোকা তরুণতনু নতুন মেলে আঁখি।