তোমারে বলেছে যারা পুত্র হতে প্রিয়, বিত্ত হতে প্রিয়তর, যা-কিছু আত্মীয় সব হতে প্রিয়তম নিখিল ভুবনে, আত্মার অন্তরতর, তাদের চরণে পাতিয়া রাখিতে চাহি হৃদয় আমার। সে সরল শান্ত প্রেম গভীর উদার-- সে নিশ্চিত নিঃসংশয়,সেই সুনিবিড় সহজ মিলনাবেগ, সেই চিরস্থির আত্মার একাগ্র লক্ষ্য, সেই সর্ব কাজে সহজেই সঞ্চরণ সদা তোমা-মাঝে গম্ভীর প্রশান্ত চিত্তে, হে অন্তরযামী, কেমনে করিব লাভ? পদে পদে আমি প্রেমের প্রবাহ তব সহজ বিশ্বাসে অন্তরে টানিয়া লব নিশ্বাসে নিশ্বাসে।
হৃদয়-পানে হৃদয় টানে, নয়ন-পানে নয়ন ছোটে, দুটি প্রাণীর কাহিনীটা এইটুকু বৈ নয়কো মোটে। শুক্লসন্ধ্যা চৈত্র মাসে হেনার গন্ধ হাওয়ায় ভাসে-- আমার বাঁশি লুটায় ভূমে, তোমার কোলে ফুলের পুঁজি। তোমার আমার এই-যে প্রণয় নিতান্তই এ সোজাসুজি। বাসন্তী-রঙ বসনখানি নেশার মতো চক্ষে ধরে, তোমার গাঁথা যূথীর মালা স্তুতির মতো বক্ষে পড়ে। একটু দেওয়া একটু রাখা, একটু প্রকাশ একটু ঢাকা, একটু হাসি একটু শরম-- দুজনের এই বোঝাবুঝি। তোমার আমার এই-যে প্রণয় নিতান্তই এ সোজাসুজি। মধুমাসের মিলন-মাঝে মহান কোনো রহস্য নেই, অসীম কোনো অবোধ কথা যায় না বেধে মনে-মনেই। আমাদের এই সুখের পিছু ছায়ার মতো নাইকো কিছু, দোঁহার মুখে দোঁহে চেয়ে নাই হৃদয়ের খোঁজাখুঁজি। মধুমাসে মোদের মিলন নিতান্তই এ সোজাসুজি। ভাষার মধ্যে তলিয়ে গিয়ে খুঁজি নে ভাই ভাষাতীত, আকাশ-পানে বাহু তুলে চাহি নে ভাই আশাতীত। যেটুকু দিই যেটুকু পাই তাহার বেশি আর কিছু নাই-- সুখের বক্ষ চেপে ধরে করি নে কেউ যোঝাযুঝি। মধুমাসে মোদের মিলন নিতান্তই এ সোজাসুজি। শুনেছিনু প্রেমের পাথার নাইকো তাহার কোনো দিশা, শুনেছিনু প্রেমের মধ্যে অসীম ক্ষুধা অসীম তৃষা-- বীণার তন্ত্রী কঠিন টানে ছিঁড়ে পড়ে প্রেমের তানে, শুনেছিনু প্রেমের কুঞ্জে অনেক বাঁকা গলিঘুঁজি। আমাদের এই দোঁহার মিলন নিতান্তই এ সোজাসুজি।
আমাকে এনে দিল এই বুনো চারাগাছটি । পাতার রঙ হলদে-সবুজ, ফুলগুলি যেন আলো পান করবার শিল্প-করা পেয়ালা,বেগুনি রঙের প্রশ্ন করি "নাম কী', জবাব নেই কোনোখানে । ও আছে বিশ্বের অসীম অপরিচিতের মহলে যেখানে আছে আকাশের নামহারা তারা । আমি ওকে ধরে এনেছি একটি ডাক-নামে আমার একলা জানার নিভৃতে । ওর নাম পেয়ালী । বাগানের নিমন্ত্রণে এসেছে ডালিয়া, এসেছে ফুশিয়া, এসেছে ম্যারিগোল্ড্, ও আছে অনাদরের অচিহ্নিত স্বাধীনতায়, জাতে বাঁধা পড়ে নি; ও বাউল,ও অসামাজিক । দেখতে দেখেতে ওই খসে পড়ল ফুল । যে শব্দটুকু হল বাতাসে কানে এল না । ওর কুষ্ঠির রাশিচক্র যে নিমেষগুলির সমবায়ে অণুপরিমাণ তার অঙ্ক, ওর বুকের গভীরে যে মধু আছে কণাপরিমাণ তার বিন্দু । একটুকু কালের মধ্যে সম্পূর্ণ ওর যাত্রা, একটি কল্পে যেমন সম্পূর্ণ আগুনের-পাপড়ি-মেলা সূর্যের বিকাশ । ওর ইতিহাসটুকু অতি ছোটো পাতার কোণে বিশ্বলিপিকারের অতি ছোটো কলমে লেখা । তবু তারই সঙ্গে সঙ্গে উদ্ঘাটিত হচ্ছে বৃহৎ ইতিহাস, দৃষ্টি চলে না এক পৃষ্ঠা থেকে অন্য পৃষ্ঠায় । শতাব্দীর যে নিরন্তর স্রোত বয়ে চলেছে বিলম্বিত তালের তরঙ্গের মতো, যে ধারায় উঠল নামল কত শৈলশ্রেণী, সাগরে মরুতে কত হল বেশপরিবর্তন, সেই নিরবধি কালেরই দীর্ঘ প্রবাহে এগিয়ে এসেছে এই ছোটো ফুলটির আদিম সংকল্প সৃষ্টির ঘাতপ্রতিঘাতে । লক্ষ লক্ষ বৎসর এই ফুলের ফোটা-ঝরার পথে সেই পুরাতনসংকল্প রয়েছে নুতন,রয়েছে সজীবসচল ওর শেষ সমাপ্ত ছবি আজও দেয় নি দেখা । এই দেহহীন সংকল্প,সেই রেখাহীন ছবি নিত্য হয়ে আছে কোন্অদৃশ্যেরধ্যানে! যে অদৃশ্যের অন্তহীন কল্পনায় আমি আছি, যে অদৃশ্যে বিধৃত সকল মানুষের ইতিহাস অতীতে ভবিষ্যতে ।