ছেড়ে গেলে হে চঞ্চলা, হে পুরাতন সহচরী! ইচ্ছা বটে বছর কতক তোমার জন্য বিলাপ করি, সোনার স্মৃতি গড়িয়ে তোমার বসিয়ে রাখি চিত্ততলে, একলা ঘরে সাজাই তোমায় মাল্য গেঁথে অশ্রুজলে-- নিদেন কাঁদি মাসেকখানেক তোমায় চির-আপন জেনেই-- হায় রে আমার হতভাগ্য! সময় যে নেই, সময় যে নেই। বর্ষে বর্ষে বয়স কাটে, বসন্ত যায় কথায় কথায়, বকুলগুলো দেখতে দেখতে ঝ'রে পড়ে যথায় তথায়, মাসের মধ্যে বারেক এসে অস্তে পালায় পূর্ণ-ইন্দু, শাস্ত্রে শাসায় জীবন শুধু পদ্মপত্রে শিশিরবিন্দু-- তাঁদের পানে তাকাব না তোমায় শুধু আপন জেনেই সেটা বড়োই বর্বরতা-- সময় যে নেই, সময় যে নেই । এসো আমার শ্রাবণ-নিশি, এসো আমার শরৎলক্ষ্ণী, এসো আমার বসন্তদিন লয়ে তোমার পুষ্পপক্ষী, তুমি এসো, তুমিও এসো, তুমি এসো, এবং তুমি, প্রিয়ে, তোমরা সবাই জান ধরণীর নাম মর্তভূমি-- যে যায় চলে বিরাগভরে তারেই শুধু আপন জেনেই বিলাপ করে কাটাই, এমন সময় যে নেই, সময় যে নেই। ইচ্ছে করে বসে বসে পদ্যে লিখি গৃহকোণায় "তুমিই আছ জগৎ জুড়ে'-- সেটা কিন্তু মিথ্যে শোনায়। ইচ্ছে করে কোনোমতেই সান্ত্বনা আর মান্ব না রে, এমন সময় নতুন আঁখি তাকায় আমার গৃহদ্বারে-- চক্ষু মুছে দুয়ার খুলি তারেই শুধু আপন জেনেই, কখন তবে বিলাপ করি? সময় যে নেই, সময় যে নেই।
গান দিয়ে যে তোমায় খুঁজি বাহির মনে চিরদিবস মোর জীবনে। নিয়ে গেছে গান আমারে ঘরে ঘরে দ্বারে দ্বারে, গান দিয়ে হাত বুলিয়ে বেড়াই এই ভুবনে। কত শেখা সেই শেখালো, কত গোপন পথ দেখালো, চিনিয়ে দিল কত তারা হৃদ্গগনে। বিচিত্র সুখদুখের দেশে রহস্যলোক ঘুরিয়ে শেষে সন্ধ্যাবেলায় নিয়ে এল কোন্ ভবনে।
শুধায়ো না মোরে তুমি মুক্তি কোথা, মুক্তি কারে কই, আমি তো সাধক নই, আমি গুরু নই। আমি কবি, আছি ধরণীর অতি কাছাকাছি, এ পারের খেয়ার ঘাটায়। সম্মুখে প্রাণের নদী জোয়ার-ভাঁটায় নিত্য বহে নিয়ে ছায়া আলো, মন্দ ভালো, ভেসে-যাওয়া কত কী যে, ভুলে-যাওয়া কত রাশি রাশি লাভক্ষতি কান্নাহাসি-- এক তীর গড়ি তোলে অন্য তীর ভাঙিয়া ভাঙিয়া; সেই প্রবাহের 'পরে উষা ওঠে রাঙিয়া রাঙিয়া পড়ে চন্দ্রালোকরেখা জননীর অঙ্গুলির মতো; কৃষ্ণরাতে তারা যত জপ করে ধ্যানমন্ত্র; অস্তসূর্য রক্তিম উত্তরী বুলাইয়া চলে যায়, সে তরঙ্গে মাধবীমঞ্জরি ভাসায় মাধুরীডালি, পাখি তার গান দেয় ঢালি। সে তরঙ্গনৃত্যছন্দে বিচিত্র ভঙ্গিতে চিত্ত যবে নৃত্য করে আপন সংগীতে এ বিশ্বপ্রবাহে, সে ছন্দে বন্ধন মোর, মুক্তি মোর তাহে। রাখিতে চাহি না কিছু, আঁকড়িয়া চাহি না রহিতে, ভাসিয়া চলিতে চাই সবার সহিতে বিরহমিলনগ্রন্থি খুলিয়া খুলিয়া, তরণীর পালখানি পলাতকা বাতাসে তুলিয়া।
হে মহাপথিক, অবারিত তব দশদিক। তোমার মন্দির নাই, নাই স্বর্গধাম, নাইকো চরম পরিণাম; তীর্থ তব পদে পদে; চলিয়া তোমার সাথে মুক্তি পাই চলার সম্পদে, চঞ্চলের নৃত্যে আর চঞ্চলের গানে, চঞ্চলের সর্বভোলা দানেড্ড আঁধারে আলোকে, সৃজনের পর্বে পর্বে, প্রলয়ের পলকে পলকে।