হে পদ্মা আমার, তোমায় আমায় দেখা শত শত বার। একদিন জনহীন তোমার পুলিনে, গোধূলির শুভলগ্নে হেমন্তের দিনে, সাক্ষী করি পশ্চিমের সূর্য অস্তমান তোমারে সঁপিয়াছিনু আমার পরান। অবসানসন্ধ্যালোকে আছিলে সেদিন নতমুখী বধূসম শান্ত বাক্যহীন; সন্ধ্যাতারা একাকিনী সস্নেহ কৌতুকে চেয়ে ছিল তোমাপানে হাসিভরা মুখে। সেদিনের পর হতে, হে পদ্মা আমার, তোমায় আমায় দেখা শত শত বার। নানা কর্মে মোর কাছে আসে নানা জন, নাহি জানে আমাদের পরানবন্ধন, নাহি জানে কেন আসি সন্ধ্যা-অভিসারে বালুকা শয়ন-পাতা নির্জন এ পারে। যখন মুখর তব চক্রবাকদল সুপ্ত থাকে জলাশয়ে ছাড়ি কোলাহল, যখন নিস্তব্ধ গ্রামে তব পূর্বতীরে রুদ্ধ হয়ে যায় দ্বার কুটিরে কুটিরে, তুমি কোন্ গান কর আমি কোন্ গান দুই তীরে কেহ তার পায় নি সন্ধান। নিভৃতে শরতে গ্রীষ্মে শীতে বরষায় শত বার দেখাশুনা তোমায় আমায়। কতদিন ভাবিয়াছি বসি তব তীরে পরজন্মে এ ধরায় যদি আসি ফিরে, যদি কোনো দূরতর জন্মভূমি হতে তরী বেয়ে ভেসে আসি তব খরস্রোতে-- কত গ্রাম কত মাঠ কত ঝাউঝাড় কত বালুচর কত ভেঙে-পড়া পাড় পার হয়ে এই ঠাঁই আসিব যখন জেগে উঠিবে না কোনো গভীর চেতন? জন্মান্তরে শতবার যে নির্জন তীরে গোপন হৃদয় মোর আসিত বাহিরে, আর বার সেই তীরে সে সন্ধ্যাবেলায় হবে না কি দেখাশুনা তোমায় আমায়?
কে আমার ভাষাহীন অন্তরে চিত্তের মেঘলোকে সন্তরে, বক্ষের কাছে থাকে তবুও সে রয় দূরে, থাকে অশ্রুত সুরে। ভাবি বসে, গাব আমি তারই গান-- চুপ করে থাকি সারা দিনমান, অকথিত আবেগের ব্যথা সই। মন বলে, কথা কই কথা কই! চঞ্চল শোণিতে যে সত্তার ক্রন্দন ধ্বনিতেছে অর্থ কী জানি তাহা, আদিতম আদিমের বাণী তাহা। ভেদ করি ঝঞ্ঝার আলোড়ন ছেদ করি বাষ্পের আবরণ চুম্বিল ধরাতল যে আলোক, স্বর্গের সে বালক কানে তার বলে গেছে যে কথাটি তারই স্মৃতি আজো ধরণীর মাটি দিকে দিকে বিকাশিছে ঘাসে ঘাসে-- তারই পানে চেয়ে চেয়ে সেই সুর কানে আসে। প্রাণের প্রথমতম কম্পন অশথের মজ্জায় করিতেছে বিচরণ, তারই সেই ঝংকার ধ্বনিহীন-- আকাশের বক্ষেতে কেঁপে ওঠে নিশিদিন; মোর শিরাতন্তুতে বাজে তাই; সুগভীর চেতনার মাঝে তাই নর্তন জেগে ওঠে অদৃশ্য ভঙ্গিতে অরণ্যমর্মর-সংগীতে। ওই তরু ওই লতা ওরা সবে মুখরিত কুসুমে ও পল্লবে-- সেই মহাবাণীময় গহনমৌনতলে নির্বাক স্থলে জলে শুনি আদি-ওংকার, শুনি মূক গুঞ্জন অগোচর চেতনার। ধরণীর ধূলি হতে তারার সীমার কাছে কথাহারা যে ভুবন ব্যাপিয়াছে তার মাঝে নিই স্থান, চেয়ে-থাকা দুই চোখে বাজে ধ্বনিহীন গান।