চেনাশোনার সাঁঝবেলাতে শুনতে আমি চাই-- পথে পথে চলার পালা লাগল কেমন, ভাই। দুর্গম পথ ছিল ঘরেই, বাইরে বিরাট পথ-- তেপান্তরের মাঠ কোথা-বা, কোথা-বা পর্বত। কোথা-বা সে চড়াই উঁচু, কোথা-বা উতরাই, কোথা-বা পথ নাই। মাঝে-মাঝে জুটল অনেক ভালো-- অনেক ছিল বিকট মন্দ, অনেক কুশ্রী কালো। ফিরেছিলে আপন মনের গোপন অলিগলি, পরের মনের বাহির-দ্বারে পেতেছে অঞ্জলি। আশাপথের রেখা বেয়ে কতই এলে গেলে, পাওনা ব'লে যা পেয়েছ অর্থ কি তার পেলে। অনেক কেঁদে-কেটে ভিক্ষার ধন জুটিয়েছিলে অনেক রাস্তা হেঁটে। পথের মধ্যে লুঠেল দস্যু দিয়েছিল হানা, উজাড় করে নিয়েছিল ছিন্ন ঝুলিখানা। অতি কঠিন আঘাত তারা লাগিয়েছিল বুকে-- ভেবেছিলুম, চিহ্ন নিয়ে সে সব গেছে চুকে। হাটে-বাটে মধুর যাহা পেয়েছিলুম খুঁজি, মনে ছিল, যত্নের ধন তাই রয়েছে পুঁজি। হায় রে ভাগ্য, খোলো তোমার ঝুলি। তাকিয়ে দেখো, জমিয়েছিলে ধূলি। নিষ্ঠুর যে ব্যর্থকে সে করে যে বর্জিত, দৃঢ় কঠোর মুষ্টিতলে রাখে সে অর্জিত নিত্যকালের রতন-কণ্ঠহার; চিরমূল্য দেয় সে তারে দারুণ বেদনার। আর যা-কিছু জুটেছিল না চাহিতেই পাওয়া-- আজকে তারা ঝুলিতে নেই, রাত্রিদিনের হাওয়া ভরল তারাই, দিল তারা পথে চলার মানে, রইল তারাই একতারাতে তোমার গানে গানে।
মেঘের আড়ালে বেলা কখন যে যায় বৃষ্টি পড়ে সারাদিন থামিতে না চায়। আর্দ্র-পাখা পাখিগুলি গীতগান গেছে ভুলি, নিস্তব্ধে ভিজিছে তরুলতা। বসিয়া আঁধার ঘরে বরষার ঝরঝরে মনে পড়ে কত উপকথা। কভু মনে লয় হেন এ সব কাহিনী যেন সত্য ছিল নবীন জগতে। উড়ন্ত মেঘের মতো ঘটনা ঘটিত কত, সংসার উড়িত মনোরথে। রাজপুত্র অবহেলে কোন্ দেশে যেত চলে, কত নদী কত সিন্ধু পার। সরোবর ঘাট আলা মণি হাতে নাগবালা বসিয়া বাঁধিত কেশভার। সিন্ধুতীরে কত দূরে কোন্ রাক্ষসের পুরে ঘুমাইত রাজার ঝিয়ারি। হাসি তার মণিকণা কেহ তাহা দেখিত না, মুকুতা ঢালিত অশ্রুবারি। সাত ভাই একত্তরে চাঁপা হয়ে ফুটিত রে এক বোন ফুটিত পারুল। সম্ভব কি অসম্ভব একত্রে আছিল সব দুটি ভাই সত্য আর ভুল। বিশ্ব নাহি ছিল বাঁধা না ছিল কঠিন বাধা নাহি ছিল বিধির বিধান, হাসিকান্না লঘুকায়া শরতের আলোছায়া কেবল সে ছুঁয়ে যেত প্রাণ। আজি ফুরায়েছে বেলা, জগতের ছেলেখেলা গেছে আলো-আঁধারের দিন। আর তো নাই রে ছুটি, মেঘরাজ্য গেছে টুটি, পদে পদে নিয়ম-অধীন। মধ্যাহ্নে রবির দাপে বাহিরে কে রবে তাপে আলয় গড়িতে সবে চায়। যবে হায় প্রাণপণ করে তাহা সমাপন খেলারই মতন ভেঙে যায়।