ঘন অন্ধকার রাত, বাদলের হাওয়া এলোমেলো ঝাপট দিচ্ছে চার দিকে। মেঘ ডাকছে গুরুগুরু, থরথর করছে দরজা, খড়খড় করে উঠছে জানালাগুলো। বাইরে চেয়ে দেখি সারবাঁধা সুপুরি-নারকেলের গাছ অস্থির হয়ে দিচ্ছে মাথা-ঝাঁকানি। দুলে উঠছে কাঁঠাল গাছের ঘন ডালে অন্ধকারের পিণ্ডগুলো দল-পাকানো প্রেতের মতো। রাস্তার থেকে পড়েছে আলোর রেখা পুকুরের কোণে সাপ-খেলানো আঁকাবাঁকা। মনে পড়ছে ওই পদটা-- "রজনী শাঙন ঘন, ঘন দেয়া-গরজন-- স্বপন দেখিনু হেনকালে।' সেদিন রাধিকার ছবির পিছনে কবির চোখের কাছে কোন্ একটি মেয়ে ছিল, ভালোবাসার-কুঁড়ি-ধরা তার মন। মুখচোরা সেই মেয়ে, চোখে কাজল পরা, ঘাটের থেকে নীলশাড়ি "নিঙাড়ি নিঙাড়ি' চলা। আজ এই ঝোড়ো রাতে তাকে মনে আনতে চাই-- তার সকালে, তার সাঁঝে, তার ভাষায়, তার ভাবনায়, তার চোখের চাহনিতে-- তিন-শো বছর আগেকার কবির জানা সেই বাঙালির মেয়েকে। দেখতে পাই নে স্পষ্ট করে। আজ পড়েছে যাদের পিছনের ছায়ায় তারা শাড়ির আঁচল যেমন করে বাঁধে কাঁধের 'পরে, খোঁপা যেমন করে ঘুরিয়ে পাকায় পিছনে নেমে-পড়া, মুখের দিকে যেমন করে চায় স্পষ্টচোখে, তেমন ছবিটি ছিল না সেই তিন-শো বছর আগেকার কবির সামনে। তবু-- "রজনী শাঙন ঘন... স্বপন দেখিনু হেনকালে।'শ্রাবণের রাত্রে এমনি করেই বয়েছে সেদিন বাদলের হাওয়া, মিল রয়ে গেছে সেকালের স্বপ্নে আর একালের স্বপ্নে।
জনমিয়া এ সংসারে কিছুই শিখি নি আর, শুধু গাই গান। স্নেহময়ী মার কাছে শৈশবে শিখিয়াছিনু। দু-একটি তান। শুধু জানি তাই, দিবানিশি তাই শুধু গাই। শতছিদ্রময় এই হৃদয়-বাঁশিটি লয়ে। বাজাই সতত-- দূঃখের কঠোর স্বর রাগিনী হইয়া যায়, মৃদূল নিশ্বাসে পরিণত। আঁধার জলদ যেন ইন্দ্রধনু হয়ে যায়। ভুলে যাই সকল যাতনা। ভালো যদি না লাগে সে গান ভালো সখা, তাও গাহিব না। এমন পণ্ডিত কত রয়েছেন শত শত এ সংসারতলে, আকাশের দৈতাবালা উন্মাদিনী চপলারে বেঁধে রাখে দাসত্বের লোহার শিকলে। আকাশ ধরিয়া হাতে নক্ষত্র-অক্ষর দেখি গ্রন্থ পাঠ করিছেন তাঁরা, জ্ঞানের বন্ধন যত ছিন্ন করে দিতেছেন ভাঙি ফেলি অতীতের কারা। আমি তার কিছুই করি না, আমি তার কিছুই জানি না। এমন মহান্ এ সংসারে জ্ঞানরত্নরাশির মাঝারে আমি দীন শুধু গান গাই, তোমাদের মুখপানে চাই। ভালো যদি না লাগে সে গান ভালো সখা, তাও গাহিব না। বড়ো ভয় হয়, পাছে কেহই না দেখে তারে যে জন কিছুই শেখে নাই। ওগো সখা, ভয়ে ভয়ে তাই যাহা জানি সেই গান গাই, তোমাদের মুখপানে চাই। শ্রান্ত দেহ হীনবল, নয়নে পড়িছে জল, রক্ত ঝরে চরণে আমার, নিশ্বাস বহিছে বেগে, হৃদয়-বাঁশিটি মম বাজে না বাজে না বুঝি আর। দিন গেল, সন্ধ্যা গেল, কেহ দেখিলে না চেয়ে। যত গান গাই। বুঝি কারো অবসর নাই। বুঝি কারো ভালো নাহি লাগে-- ভালো সখা, আর গাহিব না।