তুমি কি কেবল ছবি শুধু পটে লিখা। ওই যে সুদূর নীহারিকা যারা করে আছে ভিড় আকাশের নীড়; ওই যে যারা দিনরাত্রি অলো-হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী গ্রহ তারা রবি তুমি কি তাদেরি মতো সত্য নও। হায় ছবি, তুমি শুধু ছবি। চিরচঞ্চলের মাঝে তুমি কেন শান্ত হয়ে রও। পথিকের সঙ্গ লও ওগো পথহীন। কেন রাত্রিদিন সকলের মাঝে থেকে সবা হতে আছ এত দূরে স্থিরতার চির অন্তঃপুরে। এই ধূলি ধূসর অঞ্চল তুলি বায়ুভরে ধায় দিকে দিকে; বৈশাখে সে বিধবার আভরণ খুলি তপস্বিনী ধরণীরে সাজায় গৈরিকে; অঙ্গে তার পত্রলিখা দেয় লিখে বসন্তের মিলন-উষায়, এই ধূলি এও সত্য হায়; এই তৃণ বিশ্বের চরণতলে লীন এরা যে অস্থির, তাই এরা সত্য সবি-- তুমি স্থির, তুমি ছবি, তুমি শুধু ছবি। একদিন এই পথে চলেছিলে আমাদের পাশে। বক্ষ তব দুলিত নিশ্বাসে; অঙ্গে অঙ্গে প্রাণ তব কত গানে কত নাচে রচিয়াছে আপনার ছন্দ নব নব বিশ্বতালে রেখে তাল; সে যে আজ হল কত কাল। এ জীবনে আমার ভুবনে কত সত্য ছিলে। মোর চক্ষে এ নিখিলে দিকে দিকে তুমিই লিখিলে রূপের তুলিকা ধরি রসের মুরতি। সে-প্রভাতে তুমিই তো ছিলে এ-বিশ্বের বাণী মূর্তিমতী। একসাথে পথে যেতে যেতে রজনীর আড়ালেতে তুমি গেলে থামি। তার পরে আমি কত দুঃখে সুখে রাত্রিদিন চলেছি সম্মুখে। চলেছে জোয়ার-ভাঁটা আলোকে আঁধারে আকাশ-পাথারে; পথের দুধারে চলেছে ফুলের দল নীরব চরণে বরনে বরনে; সহস্রধারায় ছোটে দুরন্ত জীবন-নির্ঝরিণী মরণের বাজায়ে কিঙ্কিণী। অজানার সুরে চলিয়াছি দূর হতে দূরে-- মেতেছি পথের প্রেমে। তুমি পথ হতে নেমে যেখানে দাঁড়ালে সেখানেই আছ থেমে। এই তৃণ, এই ধূলি-- ওই তারা, ওই শশী-রবি সবার আড়ালে তুমি ছবি, তুমি শুধু ছবি। কী প্রলাপ কহে কবি। তুমি ছবি? নহে নহে, নও শুধু ছবি। কে বলে রয়েছ স্থির রেখার বন্ধনে নিস্তব্ধ ক্রন্দনে। মরি মরি, সে আনন্দ থেমে যেত যদি এই নদী হারাত তরঙ্গবেগ, এই মেঘ মুছিয়া ফেলিত তার সোনার লিখন। তোমার চিকন চিকুরের ছায়াখানি বিশ্ব হতে যদি মিলাইত তবে একদিন কবে চঞ্চল পবনে লীলায়িত মর্মর-মুখর ছায়া মাধবী-বনের হত স্বপনের। তোমায় কি গিয়েছিনু ভুলে। তুমি যে নিয়েছ বাসা জীবনের মূলে তাই ভুল। অন্যমনে চলি পথে, ভুলি নে কি ফুল। ভুলি নে কি তারা। তবুও তাহারা প্রাণের নিশ্বাসবায়ু করে সুমধুর, ভুলের শূন্যতা-মাঝে ভরি দেয় সুর। ভুলে থাকা নয় সে তো ভোলা; বিস্মৃতির মর্মে বসি রক্তে মোর দিয়েছ যে দোলা। নয়নসম্মুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই; আজি তাই শ্যামলে শ্যামল তুমি, নীলিমায় নীল। আমার নিখিল তোমাতে পেয়েছে তার অন্তরের মিল। নাহি জানি, কেহ নাহি জানে তব সুর বাজে মোর গানে; কবির অন্তরে তুমি কবি, নও ছবি, নও ছবি, নও শুধু ছবি। তোমারে পেয়েছি কোন্ প্রাতে, তার পরে হারায়েছি রাতে। তার পরে অন্ধকারে অগোচরে তোমারেই লভি। নও ছবি, নও তুমি ছবি।
এই দেহখানা বহন করে আসছে দীর্ঘকাল বহু ক্ষুদ্র মহূর্তের রাগদ্বেষ ভয়ভাবনা কামনার আবর্জনারাশি । এর আবিল আবরণে বারে বারে ঢাকা পড়ে আত্মার মুক্তরূপ । এ সত্যের মুখোশ প'রে সত্যকে আড়ালে রাখে; মৃত্যুর কাদামাটিতেই গড়ে আপনার পুতুল, তবু তার মধ্যে মৃত্যুর আভাস পেলেই নালিশ করে আর্তকন্ঠে । খেলা করে নিজেকে ভোলাতে, কেবলই ভুলতে চায় যে সেটা খেলা । প্রাণপণ সঞ্চয়ে রচনা করে মরণের অর্ঘ্য; স্তুতিনিন্দার বাষ্পবুদবুদে ফেনিল হয়ে পাক খায় ওর হাসিকান্নার আবর্ত । বক্ষ ভেদ ক'রে ও হাউইয়ের আগুন দেয় ছুটিয়ে, শূন্যের কাছ থেকে ফিরে পায় ছাই --- দিনে দিনে তাই করে স্তূপাকার । প্রতিদিন যে প্রভাতে পৃথিবী প্রথম সৃষ্টির অক্লান্ত নির্মল দেববেশে দেয় দেখা, আমি তার উন্মীলিত আলোকের অনুসরণ করে অন্বেষণ করি আপন অন্তরলোক । অসংখ্য দণ্ড পল নিমেষের জটিল মলিন জালে বিজড়িত দেহটাকে সরিয়ে ফেলি মনের থেকে যেখানে সরে যায় অন্ধকার রাতের নানা ব্যর্থ ভাবনার অত্যুক্তি, যায় বিস্মৃত দিনের অনবধানে পুঞ্জিত লেখন যত - সেই-সব নিমন্ত্রণলিপি নীরব যার আহ্বান, নিঃশেষিত যার প্রত্যুত্তর। তখন মনে পড়ে, সবিতা, তোমার কাছে ঋষিকবির প্রার্থনামন্ত্র, যে মন্ত্রে বলেছিলেন,হে পূষণ, তোমার হিরন্ময় পাত্রে সত্যের মুখ আচ্ছন্ন, উন্মুক্ত করো সেই আবরণ । আমিও প্রতিদিন উদয়দিগ্বলয় থেকে বিচ্ছুরিত রশ্মিচ্ছটায় প্রসারিত করে দিই আমার জাগরণ; বলি, হে সবিতা, সরিয়ে দাও আমার এই দেহ,এই আচ্ছাদন -- তোমার তেজোময় অঙ্গের সূক্ষ্ণ অগ্নিকণায় রচিত যে-আমার দেহের অণুপরমাণু, তারও অলক্ষ্য অন্তরে আছে তোমার কল্যাণতম রূপ, তাই প্রকাশিত হোক আমার নিরাবিল দৃষ্টিতে । আমার অন্তরতম সত্য আদি যুগে অব্যক্ত পৃথিবীর সঙ্গে তোমার বিরাটে ছিল বিলীন, সেই সত্য তোমারই । তোমার জ্যোতির স্তিমিত কেন্দ্রে মানুষ আপনার মহৎস্বরূপকে দেখেছে কালে কালে, কখনো নীল-মহানদীর তীরে, কখনো পারস্যসাগরের কূলে, কখনো হিমাদ্রিগিরিতটে -- বলেছে "জেনেছি আমরা অমৃতের পুত্র', বলেছে "দেখেছি অন্ধকারের পার হতে আদিত্যবর্ণ মহান পুরুষের আবির্ভাব' ।