মরণের ছবি মনে আনি। ভেবে দেখি শেষ দিন ঠেকেছে শেষের শীর্ণক্ষণে। আছে ব'লে যত কিছু রয়েছে দেশে কালে-- যত বস্তু, যত জীব, যত ইচ্ছা, যত চেষ্টা, যত আশানৈরাশ্যের ঘাতপ্রতিঘাত দেশে দেশে ঘরে ঘরে চিত্তে চিত্তে, যত গ্রহনক্ষত্রের দূর হতে দূরতর ঘূর্ণ্যমান স্তরে স্তরে অগণিত অজ্ঞাত শক্তির আলোড়ন আবর্তন মহাকালসমুদ্রের কূলহীন বক্ষতলে, সমস্তই আমার এ চৈতন্যের শেষ সূক্ষ্ম আকম্পিত রেখার এ ধারে। এক পা তখনো আছে সেই প্রান্তসীমায়, অন্য পা আমার বাড়িয়েছি রেখার ও ধারে, সেখানে অপেক্ষা করে অলক্ষিত ভবিষ্যৎ লয়ে দিনরজনীর অন্তহীন অক্ষমালা আলো-অন্ধকারে-গাঁথা। অসীমের অসংখ্য যা-কিছু সত্তায় সত্তায় গাঁথা প্রসারিত অতীতে ও অনাগতে। নিবিড় সে সমস্তের মাঝে অকস্মাৎ আমি নেই। একি সত্য হতে পারে। উদ্ধত এ নাস্তিত্ব যে পাবে স্থান এমন কি অণুমাত্র ছিদ্র আছে কোনোখানে। সে ছিদ্র কি এতদিনে ডুবাতো না নিখিলতরণী মৃত্যু যদি শূন্য হত, যদি হত মহাসমগ্রের রূঢ় প্রতিবাদ।
পিয়র্সন কয়েক জোড়া সবুজরঙের বিদেশী পাখি আশ্রমে ছেড়ে দিয়েছিলেন । অনেক দিন তারা এখানে বাসা বেঁধে ছিল । আজকাল আর দেখতে পাই নে । আশা করি কোনো নালিশ নিয়ে তারা চলে যায় নি, কিম্বা এখানকার অন্য আশ্রমিক পশু-পাখির সঙ্গে বর্ণভেদ বা সুরের পার্থক্য নিয়ে তাদের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা ঘটে নি । এনেছে কবে বিদেশী সখা বিদেশী পাখি আমার বনে, সকাল-সাঁঝে কুঞ্জমাঝে উঠিছে ডাকি সহজ মনে । অজানা এই সাগরপারে হল না তার গানের ক্ষতি । সবুজ তার ডানার আভা, চপল তার নাচের গতি । আমার দেশে যে-মেঘ এসে নীপবনের মরমে মেশে বিদেশী পাখি গীতালি দিয়ে মিতালি করে তাহার সনে । বটের ফলে আরতি তার , রয়েছে লোভ নিমের তরে, বনজামেরে চঞ্চু তার অচেনা ব"লে দোষী না করে । শরতে যবে শিশির বায়ে উচ্ছ্বসিত শিউলিবীথি, বাণীরে তার করে না ম্লান কুহেলিঘন পুরানো স্মৃতি । শালের ফুল-ফোটার বেলা মধুকাঙালী লোভীর মেলা, চিরমধুর বঁধুর মতো সে ফুল তার হৃদয় হরে । বেণুবনের আগের ডালে চটুল ফিঙা যখন নাচে পরদেশী এ পাখির সাথে পরানে তার ভেদ কি আছে । উষার ছোঁওয়া জাগায় ওরে ছাতিমশাখে পাতার কোলে, চোখের আগে যে ছবি জাগে মানে না তারে প্রবাস ব"লে । আলোতে সোনা,আকাশে নীলা, সেথা যে চিরজানারই লীলা, মায়ের ভাষা শোনে সেখানে শ্যামল ভাষা যেখানে গাছে ।