বিদায় দেহো, ক্ষম আমায় ভাই। কাজের পথে আমি তো আর নাই। এগিয়ে সবে যাও-না দলে দলে, জয়মাল্য লও-না তুলি গলে, আমি এখন বনচ্ছায়াতলে অলক্ষিতে পিছিয়ে যেতে চাই। তোমরা মোরে ডাক দিয়ো না ভাই। অনেক দূরে এলেম সাথে সাথে, চলেছিলেম সবাই হাতে হাতে। এইখানেতে দুটি পথের মোড়ে হিয়া আমার উঠল কেমন করে জানি নে কোন্ ফুলের গন্ধ-ঘোরে সৃষ্টিছাড়া ব্যাকুল বেদনাতে। আর তো চলা হয় না সাথে সাথে। তোমরা আজি ছুটেছ যার পাছে সে-সব মিছে হয়েছে মোর কাছে-- রত্ন খোঁজা, রাজ্য ভাঙা-গড়া, মতের লাগি দেশ-বিদেশে লড়া, আলবালে জলসেচন করা উচ্চশাখা স্বর্ণচাঁপার গাছে। পারি নে আর চলতে সবার পাছে। আকাশ ছেয়ে মন-ভোলানো হাসি আমার প্রাণে বাজালো আজ বাঁশি। লাগল আলস পথে চলার মাঝে, হঠাৎ বাধা পড়ল সকল কাজে, একটি কথা পরান জুড়ে বাজে "ভালোবাসি, হায় রে ভালোবাসি'-- সবার বড়ো হৃদয়-হরা হাসি। তোমরা তবে বিদায় দেহো মোরে-- অকাজ আমি নিয়েছি সাধ করে। মেঘের পথের পথিক আমি আজি হাওয়ার মুখে চলে যেতেই রাজি, অকূল-ভাসা তরীর আমি মাঝি বেড়াই ঘুরে অকারণের ঘোরে। তোমরা সবে বিদায় দেহো মোরে।
ছোটো কাঠের সিঙ্গি আমার ছিল ছেলেবেলায়, সেটা নিয়ে গর্ব ছিল বীরপুরুষি খেলায়। গলায় বাঁধা রাঙা ফিতের দড়ি, চিনেমাটির ব্যাঙ বেড়াত পিঠের উপর চড়ি। ব্যাঙটা যখন পড়ে যেত ধম্কে দিতেম কষে, কাঠের সিঙ্গি ভয়ে পড়ত বসে। গাঁ গাঁ করে উঠছে বুঝি, যেমনি হত মনে, "চুপ করো" যেই ধম্কানো আর চম্কাত সেইখনে। আমার রাজ্যে আর যা থাকুক সিংহভয়ের কোনো সম্ভাবনা ছিল না কখ্খোনো। মাংস ব'লে মাটির ঢেলা দিতেম ভাঁড়ের 'পরে, আপত্তি ও করত না তার তরে। বুঝিয়ে দিতেম, গোপাল যেমন সুবোধ সবার চেয়ে তেমনি সুবোধ হওয়া তো চাই যা দেব তাই খেয়ে। ইতিহাসে এমন শাসন করে নি কেউ পাঠ, দিবানিশি কাঠের সিঙ্গি ভয়েই ছিল কাঠ। খুদি কইত মিছিমিছি, "ভয় করছে, দাদা।" আমি বলতেম, "আমি আছি, থামাও তোমার কাঁদা-- যদি তোমায় খেয়েই ফেলে এমনি দেব মার দু চক্ষে ও দেখবে অন্ধকার।" মেজ্দিদি আর ছোড়্দিদিদের খেলা পুতুল নিয়ে, কথায় কথায় দিচ্ছে তাদের বিয়ে নেমন্তন্ন করত যখন যেতুম বটে খেতে, কিন্তু তাদের খেলার পানে চাইনি কটাক্ষেতে। পুরুষ আমি, সিঙ্গিমামা নত পায়ের কাছে, এমন খেলার সাহস বলো ক'জন মেয়ের আছে।
রাজার মতো বেশে তুমি সাজাও যে শিশুরে পরাও যারে মণিরতন-হার-- খেলাধুলা আনন্দ তার সকলি যায় ঘুরে, বসন-ভুষণ হয় যে বিষম ভার। ছেঁড়ে পাছে আঘাত লাগি, পাছে ধুলায় হয় সে দাগি, আপনাকে তাই সরিয়ে রাখে সবার হতে দূরে, চলতে গেলে ভাবনা ধরে তার-- রাজার মতো বেশে তুমি সাজাও যে শিশুরে, পরাও যারে মণিরতন-হার। কী হবে মা অমনতরো রাজার মতো সাজে, কী হবে ওই মণিরতন-হারে। দুয়ার খুলে দাও যদি তো ছুটি পথের মাঝে রৌদ্রবায়ু-ধুলাকাদার পাড়ে। যেথায় বিশ্বজনের মেলা সমস্ত দিন নানান খেলা, চারি দিকে বিরাট গাথা বাজে হাজার সুরে, সেথায় সে যে পায় না অধিকার, রাজার মতো বেশে তুমি সাজাও যে শিশুরে, পরাও যারে মণিরতন-হার।