শ্রীমান ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কল্যাণীয়েষু আমার কাছে শুনতে চেয়েছ গানের কথা; বলতে ভয় লাগে, তবু কিছু বলব। মানুষের জ্ঞান বানিয়ে নিয়েছে আপন সার্থক ভাষা। মানুষের বোধ অবুঝ, সে বোবা, যেমন বোবা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। সেই বিরাট বোবা আপনাকে প্রকাশ করে ইঙ্গিতে, ব্যাখ্যা করে না। বোবা বিশ্বের আছে ভঙ্গি, আছে ছন্দ, আছে নৃত্য আকাশে আকাশে। অণুপরমাণু অসীম দেশে কালে বানিয়েছে আপন আপন নাচের চক্র, নাচছে সেই সীমায় সীমায়; গড়ে তুলছে অসংখ্য রূপ। তার অন্তরে আছে বহ্নিতেজের দুর্দাম বোধ সেই বোধ খুঁজছে আপন ব্যঞ্জনা, ঘাসের ফুল থেকে শুরু ক'রে আকাশের তারা পর্যন্ত। মানুষের বোধের বেগ যখন বাঁধ মানে না, বাহন করতে চায় কথাকে,-- তখন তার কথা হয়ে যায় বোবা, সেই কথাটা খোঁজে ভঙ্গি, খোঁজে ইশারা, খোঁজে নাচ, খোঁজে সুর, দেয় আপনার অর্থকে উলটিয়ে, নিয়মকে দেয় বাঁকা ক'রে। মানুষ কাব্যে রচে বোবার বাণী। মানুষের বোধ যখন বাহন করে সুরকে তখন বিদ্যুচ্চঞ্চল পরমাণুপুঞ্জের মতোই সুরসংঘকে বাঁধে সীমায়, ভঙ্গি দেয় তাকে, নাচায় তাকে বিচিত্র আবর্তনে। সেই সীমায়-বন্দী নাচন পায় গানে-গড়া রূপ। সেই বোবা রূপের দল মিলতে থাকে। সৃষ্টির অন্দরমহলে, সেখানে যত রূপের নটী আছে ছন্দ মেলায় সকলের সঙ্গে নূপুর-বাঁধা চাঞ্চল্যের দোলযাত্রায়। আমি যে জানি এ-কথা যে-মানুষ জানায় বাক্যে হোক সুরে হোক, রেখায় হোক, সে পণ্ডিত। আমি যে রস পাই, ব্যথা পাই, রূপ দেখি, এ-কথা যার প্রাণ বলে গান তারি জন্যে, শাস্ত্রে সে আনাড়ি হলেও তার নাড়িতে বাজে সুর। যদি সুযোগ পাও কথাটা নারদমুনিকে শুধিয়ো, ঝগড়া বাধাবার জন্যে নয়, তত্ত্বের পার পাবার জন্যে সংজ্ঞার অতীতে।
আমাকে এনে দিল এই বুনো চারাগাছটি । পাতার রঙ হলদে-সবুজ, ফুলগুলি যেন আলো পান করবার শিল্প-করা পেয়ালা,বেগুনি রঙের প্রশ্ন করি "নাম কী', জবাব নেই কোনোখানে । ও আছে বিশ্বের অসীম অপরিচিতের মহলে যেখানে আছে আকাশের নামহারা তারা । আমি ওকে ধরে এনেছি একটি ডাক-নামে আমার একলা জানার নিভৃতে । ওর নাম পেয়ালী । বাগানের নিমন্ত্রণে এসেছে ডালিয়া, এসেছে ফুশিয়া, এসেছে ম্যারিগোল্ড্, ও আছে অনাদরের অচিহ্নিত স্বাধীনতায়, জাতে বাঁধা পড়ে নি; ও বাউল,ও অসামাজিক । দেখতে দেখেতে ওই খসে পড়ল ফুল । যে শব্দটুকু হল বাতাসে কানে এল না । ওর কুষ্ঠির রাশিচক্র যে নিমেষগুলির সমবায়ে অণুপরিমাণ তার অঙ্ক, ওর বুকের গভীরে যে মধু আছে কণাপরিমাণ তার বিন্দু । একটুকু কালের মধ্যে সম্পূর্ণ ওর যাত্রা, একটি কল্পে যেমন সম্পূর্ণ আগুনের-পাপড়ি-মেলা সূর্যের বিকাশ । ওর ইতিহাসটুকু অতি ছোটো পাতার কোণে বিশ্বলিপিকারের অতি ছোটো কলমে লেখা । তবু তারই সঙ্গে সঙ্গে উদ্ঘাটিত হচ্ছে বৃহৎ ইতিহাস, দৃষ্টি চলে না এক পৃষ্ঠা থেকে অন্য পৃষ্ঠায় । শতাব্দীর যে নিরন্তর স্রোত বয়ে চলেছে বিলম্বিত তালের তরঙ্গের মতো, যে ধারায় উঠল নামল কত শৈলশ্রেণী, সাগরে মরুতে কত হল বেশপরিবর্তন, সেই নিরবধি কালেরই দীর্ঘ প্রবাহে এগিয়ে এসেছে এই ছোটো ফুলটির আদিম সংকল্প সৃষ্টির ঘাতপ্রতিঘাতে । লক্ষ লক্ষ বৎসর এই ফুলের ফোটা-ঝরার পথে সেই পুরাতনসংকল্প রয়েছে নুতন,রয়েছে সজীবসচল ওর শেষ সমাপ্ত ছবি আজও দেয় নি দেখা । এই দেহহীন সংকল্প,সেই রেখাহীন ছবি নিত্য হয়ে আছে কোন্অদৃশ্যেরধ্যানে! যে অদৃশ্যের অন্তহীন কল্পনায় আমি আছি, যে অদৃশ্যে বিধৃত সকল মানুষের ইতিহাস অতীতে ভবিষ্যতে ।