দার্জিলিং, অগ্রহায়ণ?  ১৩৩৮


 

অপূর্ণ (opurno)


যে ক্ষুধা চক্ষের মাঝে, যেই ক্ষুধা কানে,

         স্পর্শের যে ক্ষুধা ফিরে দিকে দিকে বিশ্বের আহ্বানে

     উপকরণের ক্ষুধা কাঙাল প্রাণের,

ব্রত তার বস্তু সন্ধানের,

                                  মনের যে-ক্ষুধা চাহে ভাষা,

                       সঙ্গের যে ক্ষুধা নিত্য পথ চেয়ে করে কার আশা,

                               যে ক্ষুধা উদ্দেশহীন অজানার লাগি

                          অন্তরে গোপনে রয় জাগি--

                                   সবে তারা মিলি নিতি নিতি

                       নানা আকর্ষণবেগে গড়ি তোলে মানস-আকৃতি।

        কত সত্য, কত মিথ্যা, কত আশা, কত অভিলাষ,

কত-না সংশয় তর্ক, কত-না বিশ্বাস,

                       আপন রচিত ভয়ে আপনারে পীড়ন কত-না,

কত রূপে কল্পিত সান্ত্বনা--

মনগড়া দেবতারে নিয়ে কাটে বেলা,

                পরদিনে ভেঙে করে ঢেলা,

অতীতের বোঝা হতে আবর্জনা কত

                  জটিল অভ্যাসে পরিণত,

         বাতাসে বাতাসে ভাসা বাক্যহীন কত-না আদেশ

           দেহহীন তর্জনীনির্দেশ,

                          হৃদয়ের গূঢ় অভিরুচি

                         কত স্বপ্নমূর্তি আঁকে দেয় পুন মুছি,

                         কত প্রেম, কত ত্যাগ, অসম্ভব তরে

                         কত-না আকাশযাত্রা কল্পপক্ষভরে,

                     কত মহিমার পূজা, অযোগ্যের কত আরাধনা,

                     সার্থক সাধনা কত, কত ব্যর্থ আত্মবিড়ম্বনা,

                                   কত জয় কত পরাভব--

                        ঐক্যবন্ধে বাঁধি এই-সব

                                   ভালো মন্দ সাদায় কালোয়

                    বস্তু ও ছায়ায় গড়া মূর্তি তুমি দাঁড়ালে আলোয়।

জন্মদিনে জন্মদিনে গাঁথনির কর্ম হবে শেষ,

                                 সুখ দুঃখ ভয় লজ্জা ক্লেশ,

আরব্ধ ও অনারব্ধ সমাপ্ত ও অসমাপ্ত কাজ,

                      তৃপ্ত ইচ্ছা, ভগ্ন জীর্ণ সাজ--

তুমি-রূপে পুঞ্জ হয়ে, শেষে

কয়দিন পূর্ণ করি কোথা গিয়ে মেশে।

   যে চৈতন্যধারা

সহসা উদ্ভূত হয়ে অকস্মাৎ হবে গতিহারা,

          সে কিসের লাগি--

                      নিদ্রায় আবিল কভু,কখনো-বা জাগি

বাস্তবে ও কল্পনায় আপনার রচি দিল সীমা,

গড়িল প্রতিমা।

অসংখ্য এ রচনায় উদ্‌ঘাটিতে মহা-ইতিহাস

     যুগান্তে ও যুগান্তরে এ কার বিলাস।

জন্মদিন মৃত্যুদিন, মাঝে তারি ভরি প্রাণভূমি

                                  কে গো তুমি।

                            কোথা আছে তোমার ঠিকানা,

   কার কাছে তুমি আছ অন্তরঙ্গ সত্য করে জানা।

   আছ আর নাই মিলে অসম্পূর্ণ তব সত্তাখানি

                         আপন গদগদ বাণী

    পারে না করিতে ব্যক্ত, অশক্তির নিষ্ঠুর বিদ্রোহে

                           বাধা পায় প্রকাশ আগ্রহে,

    মাঝখানে থেমে যায় মৃত্যুর শাসনে।

         তোমার যে সম্ভাষণে

জানাইতে চেয়েছিলে নিখিলেরে নিজ পরিচয়

                          হঠাৎ কি তাহার বিলয়,

   কোথাও কি নাই তার শেষ সার্থকতা।

  তবে কেন পঙ্গু সৃষ্টি, খণ্ডিত এ অস্তিত্বের ব্যথা।  

                           অপূর্ণতা আপনার বেদনায়

              পূর্ণের আশ্বাস যদি নাহি পায়,

                  তবে রাত্রিদিন হেন

                আপনার সাথে তার এত দ্বন্দ্ব কেন।

                  ক্ষুদ্র বীজ মৃত্তিকার সাথে যুঝি

       অঙ্কুরি উঠিতে চাহে আলোকের মাঝে মুক্তি খুঁজি।

সে মুক্তি না যদি সত্য হয়

  অন্ধ মূক দুঃখে তার হবে কি অনন্ত পরাজয়।

 

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •