শান্তিনিকেতন, ৭ জুলাই, ১৯৩৮


 

     ইস্‌টেশন (isteshon)


সকাল বিকাল ইস্টেশনে আসি,

চেয়ে চেয়ে দেখতে ভালবাসি।

ব্যস্ত হয়ে ওরা টিকিট কেনে,

ভাঁটির ট্রেনে কেউ-বা চড়ে

কেউ-বা উজান ট্রেনে।

সকাল থেকে কেউ-বা থাকে বসে,

কেউ-বা গাড়ি ফেল্‌ করে তার

শেষ-মিনিটের দোষে।

          দিনরাত গড়্‌গড়্‌ ঘড়্‌ঘড়্‌,

          গাড়িভরা মানুষের ছোটে ঝড়।

          ঘন ঘন গতি তার ঘুরবে

          কভু পশ্চিমে, কভু পূর্বে।

চলচ্ছবির এই-যে মূর্তিখানি

      মনেতে দেয় আনি

নিত্য-মেলার নিত্য-ভোলার ভাষা--

      কেবল যাওয়া-আসা।

মঞ্চতলে দণ্ডে পলে

      ভিড় জমা হয় কত--

পতাকাটা দেয় দুলিয়ে,

            কে কোথা হয় গত।

এর পিছনে সুখদুঃখ-

          ক্ষতিলাভের তাড়া

               দেয় সবলে নাড়া।

               সময়ের ঘড়িধরা অঙ্কেতে

               ভোঁ ভোঁ ক'রে বাঁশি বাজে সংকেতে।

               দেরি নাহি সয় কারো কিছুতেই

              কেহ যায়, কেহ থাকে পিছুতেই।

ওদের চলা ওদের পড়ে-থাকায়

আর কিছু নেই, ছবির পরে

          কেবল ছবি আঁকায়।

খানিকক্ষণ যা চোখে পড়ে

          তার পরে যায় মুছে,

আত্ম-অবহেলার খেলা

          নিত্যই যায় ঘুচে।

ছেঁড়া পটের টুকরো জমে

          পথের প্রান্ত জুড়ে,

তপ্ত দিনের ক্লান্ত হাওয়ায়

          কোন্‌খানে যায় উড়ে।

"গেল গেল' ব'লে যারা

          ফুকরে কেঁদে ওঠে

ক্ষণেক-পরে কান্না-সমেত

          তারাই পিছে ছোটে।

                   ঢং ঢং বেজে ওঠে ঘণ্টা,

                   এসে পড়ে বিদায়ের ক্ষণটা।

                   মুখ রাখে জানলায় বাড়িয়ে,

                   নিমেষেই নিয়ে যায় ছাড়িয়ে।

চিত্রকরের বিশ্বভুবনখানি--

     এই কথাটাইনিলেম মনে মানি।

কর্মকারের নয় এ গড়া-পেটা--

আঁকড়ে ধরার জিনিস এ নয়,

      দেখার জিনিস এটা।

কালের পরে যায় চলে কাল,

      হয় না কভু হারা

ছবির বাহন চলাফেরার ধারা।

দুবেলা সেই এ সংসারের

      চলতি ছবি দেখা,

এই নিয়ে রই যাওয়া-আসাআর

      ইস্টেশনে একা।

                  

          এক তুলি ছবিখানা এঁকে দেয়,

          আর তুলি কালি তাহে মেখে দেয়।

          আসে কারা এক দিক হতে ঐ,

          ভাসে কারা বিপরীত স্রোতে ঐ।

 

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •