পথ দিয়ে কে যায় গো চলে ডাক দিয়ে সে যায়। আমার ঘরে থাকাই দায়। পথের হাওয়ায় কী সুর বাজে, বাজে আমার বুকের মাঝে বাজে বেদনায়। আমার ঘরে থাকাই দায়। পূর্ণিমাতে সাগর হতে ছুটে এল বান, আমার লাগল প্রাণে টান। আপন মনে মেলে আঁখি আর কেন বা পড়ে থাকি কিসের ভাবনায়? আমার ঘরে থাকাই দায়।
সংসারে মোরে রাখিয়াছ যেই ঘরে সেই ঘরে রব সকল দুঃখ ভুলিয়া। করুণা করিয়া নিশিদিন নিজ করে রেখে দিয়ো তার একটি দুয়ার খুলিয়া। মোর সব কাজে মোর সব অবসরে সে দুয়ার রবে তোমারি প্রবেশ-তরে, সেথা হতে বায়ু বহিবে হৃদয়-'পরে চরণ হতে তব পদরজ তুলিয়া। সে দুয়ার খুলি আসিবে তুমি এ ঘরে, আমি বাহিরিব সে দুয়ারখানি খুলিয়া। আর যত সুখ পাই বা না পাই, তবু এক সুখ শুধু মোর তরে তুমি রাখিয়ো। সে সুখ কেবল তোমার আমার প্রভু, সে সুখের 'পরে তুমি জাগ্রত থাকিয়ো। তাহারে না ঢাকে আর যত সুখগুলি, সংসার যেন তাহাতে না দেয় ধূলি, সব কোলাহল হতে তারে তুমি তুলি যতন করিয়া আপন অঙ্কে ঢাকিয়ো। আর যত সুখে ভরুক ভিক্ষাঝুলি, সেই এক সুখ মোর তরে তুমি রাখিয়ো। যত বিশ্বাস ভেঙে ভেঙে যায়, স্বামী, এক বিশ্বাস রহে যেন চিতে লাগিয়া। যে অনলতাপ যখনি সহিব আমি দেয় যেন তাহে তব নাম বুকে দাগিয়া। দুখ পশে যবে মর্মের মাঝখানে তোমার লিখন-স্বাক্ষর যেন আনে, রুক্ষ বচন যতই আঘাত হানে সকল আঘাতে তব সুর উঠে জাগিয়া। শত বিশ্বাস ভেঙে যদি যায় প্রাণে এক বিশ্বাসে রহে যেন মন লাগিয়া।
পথ চেয়ে তো কাটল নিশি, লাগছে মনে ভয়-- সকালবেলা ঘুমিয়ে পড়ি যদি এমন হয়। যদি তখন হঠাৎ এসে দাঁড়ায় আমার দুয়ার-দেশে। বনচ্ছায়ায় ঘেরা এ ঘর আছে তো তার জানা-- ওগো, তোরা পথ ছেড়ে দিস, করিস নে কেউ মানা। যদি-বা তার পায়ের শব্দে ঘুম না ভাঙে মোর, শপথ আমার, তোরা কেহ ভাঙাস নে সে ঘোর। চাই নে জাগতে পাখির রবে নতুন আলোর মহোৎসবে, চাই নে জাগতে হাওয়ায় আকুল বকুল ফুলের বাসে-- তোরা আমায় ঘুমোতে দিস যদিই-বা সে আসে। ওগো, আমার ঘুম যে ভালো গভীর অচেতনে-- যদি আমায় জাগায় তারি আপন পরশনে। ঘুমের আবেশ যেমনি টুটি দেখব তারি নয়নদুটি মুখে আমার তারি হাসি পড়বে সকৌতুকে-- সে যেন মোর সুখের স্বপন দাঁড়াবে সম্মুখে। সে আসবে মোর চোখের 'পরে সকল আলোর আগে, তাহারি রূপ মোর প্রভাতের প্রথম হয়ে জাগে। প্রথম চমক লাগবে সুখে চেয়ে তারি করুণ মুখে, চিত্ত আমার উঠবে কেঁপে তার চেতনায় ভ'রে-- তোরা আমায় জাগাস নে কেউ, জাগাবে সেই মোরে।