কোনো কোনো ক্ষমতাশালী লেখকের প্রতিভায় কী একটি গ্রহদোষে অসম্পূর্ণতার অভিশাপ থাকিয়া যায়; তাঁহারা অনেক লিখিলেও মনে হয় তাঁহাদের সব লেখা শেষ হয় নাই। তাঁহাদের প্রতিভাকে আমরা সুসংলগ্ন আকারবদ্ধভাবে পাই না; বুঝিতে পারি তাহার মধ্যে বৃহত্ত্বের মহত্ত্বের অনেক উপাদান ছিল, কেবল সেই সংযোজনা ছিল না যাহার প্রভাবে সে আপনাকে সর্বসাধারণের নিকট সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়ে প্রকাশ ও প্রমাণ করিতে পারে। সঞ্জীবচন্দ্রের প্রতিভা পূর্বোক্ত শ্রেণীর। তাঁহার রচনা হইতে অনুভব করা যায় তাঁহার প্রতিভার অভাব ছিল না, কিন্তু সেই প্রতিভাকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করিয়া যাইতে পারেন নাই। তাঁহার হাতের কাজ দেখিলে মনে হয়, তিনি যতটা কাজে দেখাইয়াছেন তাঁহার সাধ্য তদপেক্ষা অনেক অধিক ছিল। তাঁহার মধ্যে যে পরিমাণে ক্ষমতা ছিল সে পরিমাণে উদ্যম ছিল না।
রাস্কিন এক জায়গায় বলিয়াছেন, মহৎ আর্ট মাত্রই স্তব। সেইসঙ্গেই তাঁহাকে বলিতে হইয়াছে, কোনো বড়ো জিনিসকে সংজ্ঞার দ্বারা বাঁধা সহজ নহে-- অতএব, আর্ট ব্যাপারটা যে স্তব, সেটা খোলসা করিয়া বোঝানো আবশ্যক। মানুষ বিশ্বসংসারে যাহা ভালোবাসে, আর্টের দ্বারা তাহার স্তব করে। সুন্দর গড়ন দিয়া মানুষ যখন একটা সামান্য ঘট প্রস্তুত করে, তখন সে কী করে? না, রেখার যে মনোহর রহস্য আমরা ফুলের পাপড়ির মধ্যে, ফলের পূর্ণতার মধ্যে, পাতার ভঙ্গিমায়, জীবশরীরের লাবণ্যে দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছি, মানুষ ঘটের গঠনে বিশ্বের সেই রেখাবিন্যাস-চাতুরীর প্রশংসা করে। বলে যে, জগতে চোখ মেলিয়া এই-সকল বিচিত্র সুষমা আমার ভালো লাগিয়াছে।
অল্পক্ষণের জন্যে আপনি আমাদের মধ্যে এসেছেন কিন্তু সেই সৌভাগ্যকে আমি অল্প বলে মনে করি নে। আমার নিবেদন এই যে আমার এ কথাকে আপনি অত্যুক্তি ব'লে মনে করবেন না যে আপনার দর্শন আমাদের হৃদয়ের মধ্যে নূতন শক্তি সঞ্চার করেছে। প্রেমের উপদেশ মুখে ব'লে ফল হয় না, যাঁরা প্রেমিক তাঁদের সঙ্গই প্রেমের স্পর্শমণি, তার স্পর্শে, আমাদের অন্তরে যেটুকু ভালোবাসা আছে তার মূল্য বেড়ে যায়। অল্পক্ষণের জন্য আপনাকে আমরা পেয়েছি কিন্তু এই ঘটনাকে ক্ষণের মাপ দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। যে মহাপুরুষদের হৃদয় সকল মানুষের জন্য, সকল দেশই যাঁদের দেশ, তাঁরা যে-কালকে উপস্থিতমতো অধিকার করেন তাকে অতিক্রম করেন, তাঁরা সকল কালের। এখানে আপনার ক্ষণিক উপস্থিতি আশ্রমের হৃদয়ে স্থায়ী হয়ে রইল।