দাও-না ছুটি, কেমন করে বুঝিয়ে বলি কোন্খানে। যেখানে ওই শিরীষবনের গন্ধপথে মৌমাছিদের কাঁপছে ডানা সারাবেলা। যেখানেতে মেঘ-ভাসা ওই সুদূরতা, জলের প্রলাপ যেখানে প্রাণ উদাস করে সন্ধ্যাতারা ওঠার মুখে, যেখানে সব প্রশ্ন গেছে থেমে-- শূন্য ঘরে অতীত স্মৃতি গুন্গুনিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে রাখে না আর বাদলরাতে। যেখানে এই মন গোরুচরা মাঠের মধ্যে স্তব্ধ বটের মতো গাঁয়ে-চলা পথের পাশে। কেউ বা এসে প্রহরখানেক বসে তলায়, পা ছড়িয়ে কেউ বা বাজায় বাঁশি, নববধূর পাল্কিখানা নামিয়ে রাখে ক্লান্ত দুই পহরে; কৃষ্ণ-একাদশীর রাতে ছায়ার সঙ্গে ঝিল্লিরবে জড়িয়ে পড়ে চাঁদের শীর্ণ আলো। যাওয়া-আসার স্রোত বহে যায় দিনে রাতে-- ধরে-রাখার নাই কোনো আগ্রহ, দূরে রাখার নাই তো অভিমান। রাতের তারা স্বপ্নপ্রদীপখানি ভোরের আলোয় ভাসিয়ে দিয়ে যায় চলে, তার দেয় না ঠিকানা।
আমায় যদি মনটি দেবে দিয়ো, দিয়ো মন-- মনের মধ্যে ভাবনা কিন্তু রেখো সারাক্ষণ। খোলা আমার দুয়ারখানা, ভোলা আমার প্রাণ-- কখন যে কার আনাগোনা নইকো সাবধান। পথের ধারে বাড়ি আমার, থাকি গানের ঝোঁকে-- বিদেশী সব পথিক এসে যেথা-সেথাই ঢোকে। ভাঙে কতক, হারায় কতক যা আছে মোর দামি-- এমনি ক'রে একে একে সর্বস্বান্ত আমি। আমায় যদি মনটি দেবে দিয়ো, দিয়ো মন-- মনের মধ্যে ভাবনা কিন্তু রেখো সারাক্ষণ। আমায় যদি মনটি দেবে নিষেধ তাহে নাই, কিছুর তরে আমায় কিন্তু কোরো না কেউ দায়ী। ভুলে যদি শপথ ক'রে বলি কিছু কবে, সেটা পালন না করি তো মাপ করিতেই হবে। ফাগুন মাসে পূর্ণিমাতে যে নিয়মটা চলে রাগ কোরো না চৈত্র মাসে সেটা ভন্গ হলে। কোনো দিন বা পূজার সাজি কুসুমে হয় ভরা, কোনো দিন বা শূন্য থাকে-- মিথ্যা সে দোষ ধরা। আমায় যদি মনটি দেবে নিষেধ তাহে নাই, কিছুর তরে আমায় কিন্তু কোরো না কেউ দায়ী। আমায় যদি মনটি দেবে রাখিয়া যাও তবে, দিয়েছ যে সেটা কিন্তু ভুলে থাকতে হবে। দুটি চক্ষে বাজবে তোমার নবরাগের বাঁশি, কণ্ঠে তোমার উচ্ছ্বসিয়া উঠবে হাসিরাশি। প্রশ্ন যদি শুধাও কভু মুখটি রাখি বুকে, মিথ্যা কোনো জবাব পেলে হেসো সকৌতুকে। যে দুয়ারটা বন্ধ থাকে বন্ধ থাকতে দিয়ো, আপনি যাহা এসে পড়ে তাহাই হেসে নিয়ো। আমায় যদি মনটি দেবে, রাখিয়া যাও তবে-- দিয়েছ যে সেটা কিন্তু ভুলে থাকতে হবে।
নিত্য তোমার পায়ের কাছে তোমার বিশ্ব তোমার আছে কোনোখানে অভাব কিছু নাই। পূর্ণ তুমি, তাই তোমার ধনে মানে তোমার আনন্দ না ঠেকে। তাই তো একে একে যা-কিছু ধন তোমার আছে আমার ক'রে লবে। এমনি করেই হবে এ ঐশ্বর্যে তব তোমার আপন কাছে, প্রভু, নিত্য নব নব। এমনি করেই দিনে দিনে আমার চোখে লও যে কিনে তোমার সূর্যোদয়। এমনি করেই দিনে দিনে আপন প্রেমের পরশমণি, আপনি যে লও চিনে আমার পরান করি হিরন্ময়।