এই ছড়াগুলি ছেলেদের জন্যে লেখা। সবগুলো মাথায় এক নয়; রোলার চালিয়ে প্রত্যেকটি সমান সুগম করা হয়নি। এর মধ্যে অপেক্ষাকৃত জটিল যদি কোনোটা থাকে তবে তার অর্থ হবে কিছু দুরূহ, তবু তার ধ্বনিতে থাকবে সুর। ছেলেমেয়েরা অর্থ নিয়ে নালিশ করবে না, খেলা করবে ধ্বনি নিয়ে। ওরা অর্থলোভী জাত নয়। ছড়ার ছন্দ প্রাকৃত ভাষার ঘরাও ছন্দ। এ ছন্দ মেয়েদের মেয়েলি আলাপ, ছেলেদের ছেলেমি প্রলাপের বাহনগিরি করে এসেছে। ভদ্রসমাজে সভাযোগ্য হবার কোনো খেয়াল এর মধ্যে নেই। এর ভঙ্গীতে এর সজ্জায় কাব্যসৌন্দর্য সহজে প্রবেশ করে, কিন্তু সে অজ্ঞাতসারে। এই ছড়ায় গভীর কথা হালকা চালে পায়ে নূপুর বাজিয়ে চলে, গাম্ভীর্যের গুমোর রাখে না। অথচ এই ছড়ার সঙ্গে ব্যবহার করতে গিয়ে দেখা গেল, যেটাকে মনে হয় সহজ সেটাই সব চেয়ে কম সহজ।
আমার মনে একটুও নেই বৈকুন্ঠের আশা।-- ওইখানে মোর বাসা যে মাটিতে শিউরে ওঠে ঘাস, যার 'পরে ওই মন্ত্র পড়ে দক্ষিনে বাতাস। চিরদিনের আলোক-জ্বালা নীল আকাশের নীচে যাত্রা আমার নৃত্যপাগল নটরাজের পিছে। ফুল ফোটাবার যে রাগিণী বকুল শাখায় সাধা, নিষ্কারণে ওড়ার আবেগ চিলের পাখায় বাঁধা, সেই দিয়েছে রক্তে আমার ঢেউয়ের দোলাদুলি; স্বপ্নলোকে সেই উড়েছে সুরের পাখনা তুলি। দায়-ভোলা মোর মন মন্দে-ভালোয় সাদায়-কালোয় অঙ্কিত প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে গেছে দূর দিগন্ত-পানে আপন বাঁশির পথ-ভোলানো তানে। দেখা দিল দেহের অতীত কোন্ দেহ এই মোর ছিন্ন করি বস্তুবাঁধন-ডোর। শুধু কেবল বিপুল অনুভূতি, গভীর হতে বিচ্ছুরিত আনন্দময় দ্যুতি, শুধু কেবল গানেই ভাষা যার, পুষ্পিত ফাল্গুনের ছন্দে গন্ধে একাকার; নিমেষহারা চেয়ে-থাকার দূর অপারের মাঝে ইঙ্গিত যার বাজে। যে দেহেতে মিলিয়ে আছে অনেক ভোরের আলো, নাম-না-জানা অপূর্বেরে যার লেগেছে ভালো, যে দেহেতে রূপ নিয়েছে অনির্বচনীয় সকল প্রিয়ের মাঝখানে যে প্রিয়, পেরিয়ে মরণ সে মোর সঙ্গে যাবে-- কেবল রসে, কেবল সুরে, কেবল অনুভাবে।