ভিড় করেছে রঙমশালীর দলে। কেউ-বা জলে কেউ-বা তারা স্থলে। অজানা দেশ, রাত্রিদিনে পায়ের কাছের পথটি চিনে দুঃসাহসে এগিয়ে তারা চলে। কোন্ মহারাজ রথের 'পরে একা, ভালো করে যায় না তাঁরে দেখা। সূর্যতারা অন্ধকারে ডাইনে বাঁয়ে উঁকি মারে, আপন আলোয় দৃষ্টি তাদের ঠেকা। আমার মশাল সামনে ধরি না যে, তাই তো আলো চক্ষে নাহি বাজে। অন্তরে মোর রঙের শিখা চিত্তকে দেয় আপন টিকা, রঙিনকে তাই দেখি মনের মাঝে। পাখিরা রঙ ওড়ায় আকাশতলে, মাছেরা রঙ খেলায় গভীর জলে। রঙ জেগেছে বনসভায় গোলাপ চাঁপা রঙন জবায়, মেঘেরা রঙ ফোটায় পলে পলে।
নীরব ডাকে রঙমহালের রাজা হুকুম করেন, "রঙের আসর সাজা।'-- অমনি ফাগুন কোথা হতে ভেসে আসে হাওয়ার স্রোতে, পুরানোকে রাঙিয়ে করে তাজা। তাদের আসর বাহির-ভুবনেতে, ফেরে সেথায় রঙের নেশায় মেতে। আমার এ রঙ গোপন প্রাণে, আমার এ রঙ গভীর গানে, রঙের আসন ধেয়ানে দিই পেতে।
এ আমির আবরণ সহজে স্খলিত হয়ে যাক; চৈতন্যের শুভ্র জ্যোতি ভেদ করি কুহেলিকা সত্যের অমৃত রূপ করুক প্রকাশ। সর্বমানুষের মাঝে এক চিরমানবের আনন্দকিরণ চিত্তে মোর হোক বিকীরিত। সংসারের ক্ষুব্ধতার স্তব্ধ ঊর্ধ্বলোকে নিত্যের যে শান্তিরূপ তাই যেন দেখে যেতে পারি, জীবনের জটিল যা বহু নিরর্থক, মিথ্যার বাহন যাহা সমাজের কৃত্রিম মূল্যেই, তাই নিয়ে কাঙালের অশান্ত জনতা দূরে ঠেলে দিয়ে এ জন্মের সত্য অর্থ স্পষ্ট চোখে জেনে যাই যেন সীমা তার পেরোবার আগে।
প্রদীপ যখন নিবেছিল, আঁধার যখন রাতি, দুয়ার যখন বন্ধ ছিল, ছিল না কেউ সাথি-- মনে হল অন্ধকারে কে এসেছে বাহির-দ্বারে, মনে হল শুনি যেন পায়ের ধ্বনি কার, রাতের হাওয়ায় বাজল বুঝি কঙ্কণঝংকার। বারেক শুধু মনে হল খুলি, দুয়ার খুলি। ক্ষণেক পরে ঘুমের ঘোরে কখন গেনু ভুলি। "কোন্ অতিথি দ্বারের কাছে একলা রাতে বসে আছে?' ক্ষণে ক্ষণে তন্দ্রা ভেঙে মন শুধাল যবে বলেছিলেম, "আর কিছু নয়, স্বপ্ন আমার হবে।' মাঝ-গগনে সপ্ত-ঋষি স্তব্ধ গভীর রাতে জানলা হতে আমায় যেন ডাকল ইশারাতে। মনে হল "শয়ন ফেলে, দিই-না কেন আলো জ্বেলে'-- আলসভরে রইনু শুয়ে হল না দীপ জ্বালা। প্রহর পরে কাটল প্রহর, বন্ধ রইল তালা। জাগল কখন দখিন-হাওয়া কাঁপল বনের হিয়া, স্বপ্নে কথা-কওয়ার মতো উঠল মর্মরিয়া। যুথীর গন্ধ ক্ষণে ক্ষণে মূর্ছিল মোর বাতায়নে, শিহর দিয়ে গেল আমার সকল অঙ্গ চুমে। জেগে উঠে আবার কখন ভরল নয়ন ঘুমে। ভোরের তারা পুব-গগনে যখন হল গত বিদায়রাতির একটি ফোঁটা চোখের জলের মতো, হঠাৎ মনে হল তবে-- যেন কাহার করুণ রবে শিরীষ ফুলের গন্ধে আকুল বনের বীথি ব্যেপে শিশির-ভেজা তৃণগুলি উঠল কেঁপে কেঁপে। শয়ন ছেড়ে উঠে তখন খুলে দিলেম দ্বার-- হায় রে, ধুলায় বিছিয়ে গেছে যূথীর মালা কার। ওই যে দূরে, নয়ন নত, বনের ছায়ায় ছায়ার মতো মায়ার মতো মিলিয়ে গেল অরুণ-আলোয় মিশে, ওই বুঝি মোর বাহির-দ্বারের রাতের অতিথি সে। আজ হতে মোর ঘরের দুয়ার রাখব খুলে রাতে। প্রদীপখানি রইবে জ্বালা বাহির-জানালাতে। আজ হতে কার পরশ লাগি পথ তাকিয়ে রইব জাগি-- আর কোনোদিন আসবে না কি আমার পরান ছেয়ে যূথীর মালার গন্ধখানি রাতের বাতাস বেয়ে।