হালকা আমার স্বভাব, মেঘের মতো না হোক গিরিনদীর মতো। আমার মধ্যে হাসির কলরব আজও থামল না। বেদীর থেকে নেমে আসি, রঙ্গমঞ্চে বসে বাঁধি নাচের গান, তার বায়না নিয়েছি প্রভুর কাছে। কবিতা লিখি, তার পদে পদে ছন্দের ভঙ্গিমায় তারুণ্য ওঠে মুখর হয়ে, ঝিঁঝিট খাম্বাজের ঝংকার দিতে আজো সে সংকোচ করে না। আমি সৃষ্টিকর্তা পিতামহের রহস্য-সখা। তিনি অর্বাচীন নবীনদের কাছে প্রবীণ বয়সের প্রমাণ দিতে ভুলেই গেছেন। তরুণের উচ্ছৃঙ্খল হাসিতে উতরোল তাঁর কৌতুক, তাদের উদ্দাম নৃত্যে বাজান তিনি দ্রুততালের মৃদঙ্গ। তাঁর বজ্রমন্দিত গাম্ভীর্য মেঘমেদুর অম্বরে, অজস্র তাঁর পরিহাস বিকশিত কাশবনে, শরতের অকারণ হাস্যহিল্লোলে। তাঁর কোনো লোভ নেই প্রধানদের কাছে মর্যাদা পাবার; তাড়াতাড়ি কালো পাথর চাপা দেন না চাপল্যের ঝরনার মুখে। তাঁর বেলাভূমিতে ভঙ্গুর সৈকতের ছেলেমানুষি প্রতিবাদ করে না সমুদ্রের। আমাকে চান টেনে রাখতে তাঁর বয়স্যদলে, তাই আমার বার্ধক্যের শিরোপা হঠাৎ নেন কেড়ে ফেলে দেন ধুলোয়-- তার উপর দিয়ে নেচে নেচে চলে যায় বৈরাগী পাঁচ রঙের তালি-দেওয়া আলখাল্লা পরে। যারা আমার মূল্য বাড়াতে চায়, পরায় আমাকে দামি সাজ, তাদের দিকে চেয়ে তিনি ওঠেন হেসে, ও সাজ আর টিঁকতে পায় না আনমনার অনবধানে। আমাকে তিনি চেয়েছেন নিজের অবারিত মজলিসে, তাই ভেবেছি যাবার বেলায় যাব মান খুইয়ে, কপালের তিলক মুছে, কৌতুকে রসোল্লাসে। এস আমার অমানী বন্ধুরা মন্দিরা বাজিয়ে-- তোমাদের ধুলোমাখা পায়ে যদি ঘুঙুর বাঁধা থাকে লজ্জা পাব না।
এই গ্রন্থাবলীতে আমার কাব্যরচনার প্রথম পরিচয় নিয়ে দেখা দিয়েছে সন্ধ্যাসংগীত। তার পূর্বেও অনেক লেখা লিখেছি, সেগুলিকে লুপ্ত করবার চেষ্টা করেছি অনাদরে। হাতের অক্ষর পাকাবার যে খাতা ছিল বাল্যকালে সেগুলিকে যেমন অনাদরে রাখি নি, এও তেমনি। সেগুলিও ছিল যাকে বলে কপিবুক, বাইরে থেকে মডেল-লেখা নকল করবার সাধনায়। কাঁচা বয়সে পরের লেখা মক্শ করে আমরা অক্ষর ফেঁদে থাকি বটে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে তার মধ্যেও নিজের স্বাভাবিক ছাঁদ একটা প্রকাশ হতে থাকে। অবশেষে পরিণতিক্রমে সেইটেই বাইরের নকল খোলসটাকে বিদীর্ণ করে স্বরূপকে প্রকাশ করে দেয়। প্রথম বয়সের কবিতাগুলি সেই রকম কপিবুকের কবিতা। সেই কপিবুক-যুগের চৌকাঠ পেরিয়েই প্রথম দেখা দিল সন্ধ্যাসংগীত। তাকে আমের বোলের সঙ্গে তুলনা করব না, করব কচি আমের গুটির সঙ্গে, অর্থাৎ তাতে তার আপন চেহারাটা সবে দেখা দিয়েছে শ্যামল রঙে। রস ধরে নি, তাই তার দাম কম। কিন্তু সেই কবিতাই প্রথম স্বকীয় রূপ দেখিয়ে আমাকে আনন্দ দিয়েছিল। অতএব সন্ধ্যাসংগীতেই আমার কাব্যের প্রথম পরিচয়। সে উৎকৃষ্ট নয়, কিন্তু আমারই বটে। সে সময়কার অন্য সমস্ত কবিতা থেকে আপন ছন্দের বিশেষ সাজ পরে এসেছিল। সে সাজ বাজারে চলিত ছিল না।