পলা ভৌমিক

নতুনকাল

কোন্‌-সে কালের কন্ঠ হতে এসেছে এই স্বর--
          "এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা', মধ্যিখানে চর।'
          অনেক বাণীর বদল হল, অনেক বাণী চুপ,
          নতুন কালের নটরাজা নিল নতুন রূপ।
          তখন যে-সব ছেলেমেয়ে শুনেছে এই ছড়া
                   তারা ছিল আর-এক ছাঁদে-গড়া।
          প্রদীপ তারা ভাসিয়ে দিত পূজা আনত তীরে,
কী জানি কোন্‌ চোখে দেখত মকরবাহিনীরে।
                   তখন ছিল নিত্য অনিশ্চয়,
          ইহকালের পরকালের হাজার-রকম ভয়।
          জাগত রাজার দারুণ খেয়াল, বর্গি নামত দেশে,
          ভাগ্যে লাগত ভূমিকম্প হঠাৎ এক নিমেষে।
          ঘরের থেকে খিড়কিঘাটে চলতে হত ডর,
                   লুকিয়ে কোথায় রাজদস্যুর চর।
                   আঙিনাতে শুনত পালাগান,
          বিনা দোষে দেবীর কোপে সাধুর অসম্মান।
                             সামান্য ছুতায়
                   ঘরের বিবাদ গ্রামের শত্রুতায়
          গুপ্ত চালের লড়াই যেত লেগে,
          শক্তিমানের উঠত গুমর জেগে।
          হারত যে তার ঘুচত পাড়ায় বাস,
                   ভিটেয় চলত চাষ।
ধর্ম ছাড়া কারো নামে পাড়বে যে দোহাই
                   ছিল না সেই ঠাঁই।
ফিস্‌ফিসিয়ে কথা কওয়া, সংকোচে মন ঘেরা,
গৃহস্থবউ, জিব কেটে তার হঠাৎ পিছন-ফেরা--
আলতা পায়ে, কাজল চোখে, কপালে তার টিপ,
          ঘরের কোণে জ্বালে মাটির দীপ।
মিনতি তার জলে স্থলে, দোহাই-পাড়া মন,
          অকল্যাণের শঙ্কা সারাক্ষণ।
                   আয়ুলাভের তরে
বলির পশুর রক্ত লাগায় শিশুর ললাট-'পরে।
                   রাত্রিদিবস সাবধানে তার চলা,
অশুচিতার ছোঁয়াচ কোথায় যায় না কিছুই বলা।
          ও দিকেতে মাঠে বাটে দস্যুরা দেয় হানা,
          এ দিকে সংসারের পথে অপদেব্‌তা নানা।
জানা কিম্বা না-জানা সব অপরাধের বোঝা,
                   ভয়ে তারই হয় না মাথা সোজা।
এরই মধ্যে গুন্‌গুনিয়ে উঠল কাহার স্বর--
          "এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা, মধ্যিখানে চর।'
সেদিনও সেই বইতেছিল উদার নদীর ধারা,
ছায়া-ভাসান দিতেছিল সাঁজ-সকালের তারা।
হাটের ঘাটে জমেছিল নৌকো মহাজনি,
রাত না যেতে উঠেছিল দাঁড়-চালানো ধ্বনি।
          শান্ত প্রভাতকালে
সোনার রৌদ্র পড়েছিল জেলেডিঙির পালে।
          সন্ধেবেলায় বন্ধ আসা-যাওয়া,
হাঁস-বলাকার পাখার ঘায়ে চমকেছিল হাওয়া।
          ডাঙায় উনুন পেতে
রান্না চড়েছিল মাঝির বনের কিনারেতে।
          শেয়াল ক্ষণে ক্ষণে
উঠতেছিল ডেকে ডেকে ঝাউয়ের বনে বনে।
কোথায় গেল সেই নবাবের কাল,
          কাজির বিচার, শহর-কোতোয়াল।
          পুরাকালের শিক্ষা এখন চলে উজান-পথে,
          ভয়ে-কাঁপা যাত্রা সে নেই বলদ-টানা রথে।
ইতিহাসের গ্রন্থে আরো খুলবে নতুন পাতা,
নতুন রীতির সূত্রে হবে নতুন জীবন গাঁথা।
যে হোক রাজা যে হোক মন্ত্রী কেউ রবে না তারা,
          বইবে নদীর ধারা--
জেলেডিঙি চিরকালের নৌকো মহাজনি,
          উঠবে দাঁড়ের ধ্বনি।
প্রাচীন অশথ আধা ডাঙায় জলের 'পরে আধা,
সারারাত্রি গুঁড়িতে তার পান্‌সি রইবে বাঁধা।
তখনো সেই বাজবে কানে যখন যুগান্তর--
"এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা ', মধ্যিখানে চর।'

পলা ভৌমিক - অন্যান্য নিবেদন