এই গ্রন্থের প্রথম খণ্ড সমালোচনাকালে গ্রন্থের মধ্যে আধুনিক শিক্ষিত লোকের রচিত কতকগুলি সংগীত দেখিয়া আমরা ক্ষোভ প্রকাশ করিয়াছিলাম। তদুপলক্ষে সংগ্রহকার বলিতেছেন, "যখন আধুনিক অশিক্ষিত বাউলের ও বৈষ্ণবের গান সংগ্রহ করিব-- কারণ আধুনিক ও প্রাচীন গান প্রভেদ করিবার বড়ো কোনো উপায় নাই-- তখন সুশিক্ষিত সুভাবুক লোকের সুন্দর সুন্দর স্বভাবপূর্ণ সংগীত কেন সংগ্রহ করিব না আমি বুঝিতে পারি না। এই সংগ্রহের লক্ষ্য ও ভাবের বিরোধী না হইলেই আমি যথেষ্ট মনে করি।" এ সম্বন্ধে আমাদের যাহা বক্তব্য আছে নিবেদন করি। প্রথমত গ্রন্থের নাম হইতে গ্রন্থের উদ্দেশ্য বুঝা যায়। এ গ্রন্থের নাম শুনিয়া মনে হয়, বাউল সম্প্রদায়-রচিত গান অথবা বাউলদিগের অনুকরণে রচিত গান-সংগ্রহই ইহার লক্ষ্য। তবে কেন ইহাতে শঙ্করাচার্য-রচিত "মূঢ় জহীহি ধনাগমতৃষ্ণাং" ইত্যাদি সংস্কৃত গান নিবিষ্ট হইল? মুন্সী জালালউদ্দিন-রচিত "আহে বন্দে খোদা, য্বরা ছুচ্চা কারো" ইত্যাদি দুর্বোধ উর্দুগান ইহার মধ্যে দেখা যায় কেন! গ্রন্থের উদ্দেশ্যবহির্ভূত গান আরও অনেক এই গ্রন্থে দেখা যায়। একটা তো নিয়ম রক্ষা, একটা তো গণ্ডি থাকা আবশ্যক। নহিলে, বিশ্বে যত গান আছে সকলেই তো এই গ্রন্থের মধ্যে স্থান পাইবার জন্য নালিশ উপস্থিত করিতে পারে। দ্বিতীয় কথা-আমরা কেন যে প্রাচীন ও অশিক্ষিত লোকের রচিত সংগীত বিশেষ মনোযোগ সহকারে দেখিতে চাই তাহার কারণ আছে। আধুনিক শিক্ষিত লোকদিগের অবস্থা পরস্পরের সহিত প্রায় সমান। আমরা সকলেই একত্রে শিক্ষা লাভ করি, আমাদের সকলেরই হৃদয় প্রায় এক ছাঁচে ঢালাই করা। এই নিমিত্ত আধুনিক হৃদয়ের নিকট হইতে আমাদের হৃদয়ের প্রতিধ্বনি পাইলে আমরা তেমন চমৎকৃত হই না। কিন্তু, প্রাচীন সাহিত্যের মধ্যে যদি আমরা আমাদের প্রাণের গানের একটা মিল খুঁজিয়া পাই, তবে আমাদের কী বিস্ময়, কী আনন্দ! আনন্দ কেন হয়? তৎক্ষণাৎ সহসা মুহূর্তের জন্য বিদ্যুতালোকে আমাদের হৃদয়ের অতি বিপুল স্থায়ী প্রতিষ্ঠাভূমি আমরা দেখিতে পাই বলিয়া। আমরা দেখিতে পাই, মগ্নতরী হতভাগ্যের ন্যায় আমাদের এই হৃদয় ক্ষণস্থায়ী যুগলবিশেষের অভ্যাস ও শিক্ষা নামক খরস্রোতে ভাসমান বিচ্ছিন্ন কাষ্ঠখণ্ড আশ্রয় করিয়া ভাসিয়া বেড়াইতেছে না। অসীম মানবহৃদয়ের মধ্যে ইহার নীড় প্রতিষ্ঠিত। আমাদের হৃদয়ের উপরে ততই আমাদের বিশ্বাস জন্মে, সুতরাং ততই অমরা বললাভ করিতে থাকি। আমরা তখন যুগের সহিত যুগান্তরের গ্রন্থনসূত্র দেখিতে পাই। আমরা এই হৃদয়ের পানীয়, এ কি আমার নিজের হৃদয়স্থিত সংকীর্ণ কূপের পঙ্ক হইতে উত্থিত, না অভ্রভেদী মানবহৃদয়ের গঙ্গোত্রীশিখরনিঃসৃত সুদীর্ঘ অতীত কালের শ্যামল ক্ষেত্রের মধ্য দিয়া প্রবাহিত বিশ্ব সাধারণের সেবনীয় স্রোতস্বিনীর জল! যদি কোনো সুযোগে জানিতে পারি শেষোক্তটিই সত্য, তবে হৃদয় কী প্রসন্ন হয়! প্রাচীন কবিতার মধ্যে আমাদের হৃদয়ের ঐক্য দেখিতে পাইলে আমাদের হৃদয় সেই প্রসন্নতা লাভ করে! অতীত কালের প্রবাহধারা যে হৃদয়ে আসিয়া শুকাইয়া যায়, সে হৃদয় কি মরুভূমি! গ্রন্থ হইতে একটি গান উদ্ধৃত করিয়া আমাদের বক্তব্যের উপসংহার করি। সংগীত সংগ্রহ। (বাউলের গাথা)। দ্বিতীয় খণ্ড। ওরে বংশীবট, অক্ষয় বট, কোথা রে তমাল বন! ওরে বৃন্দাবনের তরুলতা শুকায়েছে কি কারণ! ওরে শ্যামকুঞ্জ, রাধা কুঞ্জ, কোথা গিরি গোবর্ধন! ঐ বুঝি এসেছি বৃন্দাবন। আমায় বলে দে রে নিতাই ধন॥ ওরে বৃন্দাবনের পশুপাখীর রব শুনি না কি কারণ! স্ত্রী শিক্ষা বিষয়ক আপত্তি খণ্ডন।-- ভাষাশিক্ষা--
রচনার সুবিধার জন্য আমার পাঁচটি পারিপার্শ্বিককে পঞ্চভূত নাম দেওয়া যাক। ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। একটা গড়া নাম দিতে গেলেই মানুষকে বদল করিতে হয়। তলোয়ারের যেমন খাপ, মানুষের তেমন নামটি ভাষায় পাওয়া অসম্ভব। বিশেষত ঠিক পাঁচ ভূতের সহিত পাঁচটা মানুষ অবিকল মিলাইব কী করিয়া?
অদৃষ্ট আমাদের জীবনের তাসে অনেকগুলির মিল রাখিয়াছেন, কিন্তু মাঝে মাঝে একটা একটা করিয়া গোলাম রাখিয়া দিয়াছেন, তাহার আর মিল খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। চিরজন্ম গোলাম-চোর খেলিয়া আসিতেছি, কত বাজি যে খেলা হইল তাহার আর সংখ্যা নাই, খোলোয়াড়দের মধ্যে কে জাঁক করিয়া বলিতে পারে যে, সে একবারও গোলাম-চোর হয় নাই? অদৃষ্টের হাতে নাকি তাস, আমরা দেখিয়া টানিতে পারি না, তাহা ছাড়া অদৃষ্টের তাস খেলায় নাকি গোলামের সংখ্যা একটি নহে, এমন অসংখ্য গোলাম আছে কাজেই সকলকেই প্রায় গোলাম-চোর হইতে হয়। আমরা সকলেই চাই-- মিলকে পাইতে ও অমিলকে তাড়াইতে। গোলাম পাইলে আমরা কোনো উপায়ে গলাবাজি করিয়া চালাকি করিয়া প্রতিবেশীর হাতে চালান করিয়া দিতে চাই। উদাহরণ দেওয়া আবশ্যক। মনে করো অ্যাকাউন্টেন্ট জেনেরালের আপিসে গোলম-চোর খেলা হইতেছে-- যতক্ষণ হিসাবে মিল হইতেছে ততক্ষণ কোনো গোলযোগ নাই। প্রথম সাহেব খেলোয়াড় যেই অমিলের গোলামটি পাইয়াছেন অমনি এক হাত দু হাত করিয়া সকলের শেষ খেলোয়াড় কেরানি বাবুটির হাতে গোলামটি চালান করিয়া দিলেন, মাঝে হইতে গরিব কেরানি বাবুটি গোলাম-চোর হইয়া দাঁড়াইলেন। দায়িত্বের গোলামটি কেহই হাতে রাখিতে চায় না। এমন প্রতি বিষয়েই গোলাম-চোর খেলা চলিতেছে। খুব সামান্য দৃষ্টান্ত দেখো। ঘোড়ার নিলামে যাঁহারা ঘোড়া কেনেন, সকলেই জানেন, যাহার হাতে খোঁড়া ঘোড়ার গোলাম আছে, কেমন কৌশলপূর্বক তোমার হাতে তাহা চালান করিয়া দেয়, যখন টানিবার উপক্রম করিয়াছ, তখন হয়তো জানিতে পার নাই, গোলাম টানিয়া চৈতন্য হইল, সেই নিলামেই গোলাম আর-একজনের হাতে চালান করিয়া দিলে। এমন দশ হাত ফিরিয়া জানি না কোন্ হতভাগ্য গোলাম-চোর হয়। বাপের হাতে একটি অতি কুরূপা কন্যার গোলাম আসিয়াছে, গোলাম-দায়গ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছেন, বেহাত করিতে পারিলে বাঁচেন, হতভাগ্য বরের হাতে বেমালুম চালান করিয়া দিলেন, বর বেচারি শুভ দৃষ্টির সময়ে দেখিল, সে গোলাম-চোর হইয়াছে।