অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না। অমন সুধা করুণ সুরে গেয়ো না। সকালবেলা সকল কাজে আসিতে যেতে পথের মাঝে আমারি এই আঙিনা দিয়ে যেয়ো না। অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না। মনের কথা রেখেছি মনে যতনে, ফিরিছ মিছে মাগিয়া সেই রতনে। তুচ্ছ অতি, কিছু সে নয়, দু চারি ফোঁটা অশ্রু ময় একটি শুধু শোণিত-রাঙা বেদনা। অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না। কাহার আশে দুয়ারে কর হানিছ? না জানি তুমি কী মোরে মনে মানিছ! রয়েছি হেথা লুকাতে লাজ, নাহিকো মোর রানীর সাজ, পরিয়া আছি জীর্ণচীর বাসনা। অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না। কী ধন তুমি এনেছ ভরি দু হাতে। অমন করি যেয়ো না ফেলি ধুলাতে। এ ঋণ যদি শুধিতে চাই কী আছে হেন, কোথায় পাই-- জনম-তরে বিকাতে হবে আপনা। অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না। ভেবেছি মনে, ঘরের কোণে রহিব। গোপন দুখ আপন বুকে বহিব। কিসের লাগি করিব আশা, বলিতে চাহি, নাহিকো ভাষা-- রয়েছে সাধ, না জানি তার সাধনা। অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না। যে-সুর তুমি ভরেছ তব বাঁশিতে উহার সাথে আমি কি পারি গাহিতে? গাহিতে গেলে ভাঙিয়া গান উছলি উঠে সকল প্রাণ, না মানে রোধ অতি অবোধ রোদনা। অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না। এসেছ তুমি গলায় মালা ধরিয়া-- নবীন বেশ, শোভন ভূষা পরিয়া। হেথায় কোথা কনক-থালা, কোথায় ফুল, কোথায় মালা-- বাসরসেবা করিবে কে বা রচনা? অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না। ভুলিয়া পথ এসেছ, সখা, এ ঘরে। অন্ধকারে মালা-বদল কে করে! সন্ধ্যা হতে কঠিন ভুঁয়ে একাকী আমি রয়েছি শুয়ে, নিবায়ে দীপ জীবননিশি যাপনা! অমন দীননয়নে আর চেয়ো না।
ছোটো কাঠের সিঙ্গি আমার ছিল ছেলেবেলায়, সেটা নিয়ে গর্ব ছিল বীরপুরুষি খেলায়। গলায় বাঁধা রাঙা ফিতের দড়ি, চিনেমাটির ব্যাঙ বেড়াত পিঠের উপর চড়ি। ব্যাঙটা যখন পড়ে যেত ধম্কে দিতেম কষে, কাঠের সিঙ্গি ভয়ে পড়ত বসে। গাঁ গাঁ করে উঠছে বুঝি, যেমনি হত মনে, "চুপ করো" যেই ধম্কানো আর চম্কাত সেইখনে। আমার রাজ্যে আর যা থাকুক সিংহভয়ের কোনো সম্ভাবনা ছিল না কখ্খোনো। মাংস ব'লে মাটির ঢেলা দিতেম ভাঁড়ের 'পরে, আপত্তি ও করত না তার তরে। বুঝিয়ে দিতেম, গোপাল যেমন সুবোধ সবার চেয়ে তেমনি সুবোধ হওয়া তো চাই যা দেব তাই খেয়ে। ইতিহাসে এমন শাসন করে নি কেউ পাঠ, দিবানিশি কাঠের সিঙ্গি ভয়েই ছিল কাঠ। খুদি কইত মিছিমিছি, "ভয় করছে, দাদা।" আমি বলতেম, "আমি আছি, থামাও তোমার কাঁদা-- যদি তোমায় খেয়েই ফেলে এমনি দেব মার দু চক্ষে ও দেখবে অন্ধকার।" মেজ্দিদি আর ছোড়্দিদিদের খেলা পুতুল নিয়ে, কথায় কথায় দিচ্ছে তাদের বিয়ে নেমন্তন্ন করত যখন যেতুম বটে খেতে, কিন্তু তাদের খেলার পানে চাইনি কটাক্ষেতে। পুরুষ আমি, সিঙ্গিমামা নত পায়ের কাছে, এমন খেলার সাহস বলো ক'জন মেয়ের আছে।
ওই আকাশ-'পরে আঁধার মেলে কী খেলা আজ খেলতে এলে তোমার মনে কী আছে তা জানব না। আমি তবুও হার মানব না, হার মানব না। তোমার সিংহ-ভীষণ রবে, তোমার সংহার-উৎসবে, তোমার দুর্যোগ-দুর্দিনে-- তোমার তড়িৎশিখায় বজ্রলিখায় তোমায় লব চিনে-- কোনো শঙ্কা মনে আনব না গো আনব না। যদি সঙ্গে চলি রঙ্গভরে কিংবা মাটির 'পরে তবুও হার মানব না হার মানব না। কভু যদি আমার চিত্তমাঝে ছিন্ন-তারে বেসুর বাজে জাগে যদি জাগুক প্রাণ যন্ত্রণা-- ওগো না পাই যদি নাইবা পেলেম সান্ত্বনা। যদি তোমার তরে আজি ফুলে সাজিয়ে থাকি সাজি, প্রদীপ জ্বালিয়ে থাকি ঘরে, তবে ছিঁড়ে গেলে পুষ্প, প্রদীপ নিবে গেলে ঝড়ে তবু ছিন্ন ফুলে করব তোমার বন্দনা। তবু নেবা-দীপের অন্ধকারে করব আঘাত তোমার দ্বারে, জাগে যদি জাগুক প্রাণে যন্ত্রণা। আমি ভেবেছিলেম তোমায় লয়ে যাবে আমার জীবন ব'য়ে দুঃখ তাপের পরশটুকু জানব না-- তাই সুখের কোণে ছিলেম পড়ে আন্মনা। আজ হঠাৎ ভীষণ বেশে তুমি দাঁড়াও যদি এসে, তোমার মত্ত চরণ ভরে আমার যত্নে-গড়া শয়নখানি ধুলায় ভেঙে পড়ে আমি তাই ব'লে তো কপালে কর হানব না। তুমি যেমন করে চেনাতে চাও তেমনি করে চিনিয়ে যাও যে-দুঃখ দাও দুঃখ তারে জানব না। তবে এসো হে মোর সুদুঃসহ ছিন্ন করে জীবন লহো বাজিয়ে তোলো ঝঞ্ঝা-ঝড়ের ঝঞ্ঝনা, আমায় দুঃখ হতে কোরো না আর বঞ্চনা। আমার বুকের পাঁজর টুটে উঠুক পূজার পদ্ম ফুটে; যেন প্রলয়-বায়ু-বেগে আমার মর্মকোষের গন্ধ ছুটে বিশ্ব উঠে জেগে। ওরে আয় রে ব্যথা সকল-বাধা-ভঞ্জনা। আজ আঁধারে ওই শূন্য ব্যেপে কণ্ঠ আমার ফিরুক কেঁপে, জাগিয়ে তোলো ঝঞ্ঝা-ঝড়ের ঝঞ্ঝনা।