একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে সকল দেহ লুটিয়ে পড়ুক তোমার এ সংসারে। ঘন শ্রাবণ-মেঘের মতো রসের ভারে নম্র নত একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে সমস্ত মন পড়িয়া থাক্ তব ভবন-দ্বারে। নানা সুরের আকুল ধারা মিলিয়ে দিয়ে আত্মহারা একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে সমস্ত গান সমাপ্ত হোক নীরব পারাবারে। হংস যেমন মানসযাত্রী, তেমনি সারা দিবসরাত্রি একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে সমস্ত প্রাণ উড়ে চলুক মহামরণ-পারে।
স্থির জেনেছিলেম, পেয়েছি তোমাকে, মনেও হয়নি তোমার দানের মূল্য যাচাই করার কথা। তুমিও মূল্য করনি দাবি। দিনের পর দিন গেল, রাতের পর রাত, দিলে ডালি উজাড় ক'রে। আড়চোখে চেয়ে আনমনে নিলেম তা ভাণ্ডারে; পরদিনে মনে রইল না। নববসন্তের মাধবী যোগ দিয়েছিল তোমার দানের সঙ্গে, শরতের পূর্ণিমা দিয়েছিল তারে স্পর্শ। তোমার কালো চুলের বন্যায় আমার দুই পা ঢেকে দিয়ে বলেছিলে "তোমাকে যা দিই তোমার রাজকর তার চেয়ে অনেক বেশি; আরো দেওয়া হল না আরো যে আমার নেই।" বলতে বলতে তোমার চোখ এল ছলছলিয়ে। আজ তুমি গেছ চলে, দিনের পর দিন আসে, রাতের পর রাত, তুমি আস না। এতদিন পরে ভাণ্ডার খুলে দেখছি তোমার রত্নমালা, নিয়েছি তুলে বুকে। যে গর্ব আমার ছিল উদাসীন সে নুয়ে পড়েছে সেই মাটিতে যেখানে তোমার দুটি পায়ের চিহ্ন আছে আঁকা। তোমার প্রেমের দাম দেওয়া হল বেদনায়, হারিয়ে তাই পেলেম তোমায় পূর্ণ ক'রে।
তবু কি ছিল না তব সুখদুঃখ যত, আশা নৈরাশ্যের দ্বন্দ্ব আমাদেরি মতো, হে অমর কবি! ছিল না কি অনুক্ষণ রাজসভা-ষড়্চক্র, আঘাত গোপন? কখনো কি সহ নাই অপমানভার, অনাদর, অবিশ্বাস, অন্যায় বিচার, অভাব কঠোর ক্রূর--নিদ্রাহীন রাতি কখনো কি কাটে নাই বক্ষে শেল গাঁথি? তবু সে সবার ঊর্ধ্বে নির্লিপ্ত নির্মল ফুটিয়াছে কাব্য তব সৌন্দর্যকমল আনন্দের সূর্য-পানে; তার কোনো ঠাঁই দুঃখদৈন্যদুর্দিনের কোনো চিহ্ন নাই। জীবনমন্থনবিষ নিজে করি পান অমৃত যা উঠেছিল করে গেছ দান।