তোমায় সৃষ্টি করব আমি এই ছিল মোর পণ। দিনে দিনে করেছিলেম তারি আয়োজন। তাই সাজালেম আমার ধুলো, আমার ক্ষুধাতৃষ্ণাগুলো, আমার যত রঙিন আবেশ, আমার দুঃস্বপন। "তুমি আমায় সৃষ্টি করো' আজ তোমারে ডাকি-- "ভাঙো আমার আপন মনের মায়া-ছায়ার ফাঁকি। তোমার সত্য, তোমার শান্তি, তোমার শুভ্র অরূপ কান্তি, তোমার শক্তি, তোমার বহ্নি ভরুক এ জীবন।'
শ্রীযুক্ত চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য সুহৃদ্বরেষু আমরা কি সত্যই চাই শোকের অবসান? আমাদের গর্ব আছে নিজের শোককে নিয়েও। আমাদের অতি তীব্র বেদনাও বহন করে না স্থায়ী সত্যকে-- সান্ত্বনা নেই এমন কথায়; এতে আঘাত লাগে আমাদের দুঃখের অহংকারে। জীবনটা আপন সকল সঞ্চয় ছড়িয়ে রাখে কালের চলাচলের পথে; তার অবিরাম-ধাবিত চাকার তলায় গুরুতর বেদনার চিহ্নও যায় জীর্ণ হয়ে, অস্পষ্ট হয়ে। আমাদের প্রিয়তমের মৃত্যু একটিমাত্র দাবি করে আমাদের কাছে সে বলে--"মনে রেখো।" কিন্তু সংখ্যা নেই প্রাণের দাবির, তার আহ্বান আসে চারিদিক থেকেই মনের কাছে; সেই উপস্থিত কালের ভিড়ের মধ্যে অতীতকালের একটিমাত্র আবেদন কখন হয় অগোচর। যদি বা তার কথাটা থাকে তার ব্যথাটা যায় চলে। তবু শোকের অভিমান জীবনকে চায় বঞ্চিত করতে। স্পর্ধা ক'রে প্রাণের দূতগুলিকে বলে-- খুলব না দ্বার। প্রাণের ফসলখেত বিচিত্র শস্যে উর্বর, অভিমানী শোক তারি মাঝখানে ঘিরে রাখতে চায় শোকের দেবত্র জমি,-- সাধের মরুভূমি বানায় সেখানটাতে, তার খাজনা দেয় না জীবনকে। মৃত্যুর সঞ্চয়গুলি নিয়ে কালের বিরুদ্ধে তার অভিযোগ। সেই অভিযোগে তার হার হতে থাকে দিনে দিনে। কিন্তু চায় না সে হার মানতে; মনকে সমাধি দিতে চায় তার নিজকৃত কবরে। সকল অহংকারই বন্ধন, কঠিন বন্ধন আপন শোকের অহংকার। ধন জন মান সকল আসক্তিতেই মোহ, নিবিড় মোহ আপন শোকের আসক্তিতে।
চতুর্দিকে বহ্নিবাষ্প শূন্যাকাশে ধায় বহুদূরে, কেন্দ্রে তার তারাপুঞ্জ মহাকাল-চক্ররথে ঘুরে। কত বেগ, কত তাপ, কত ভার, কত আয়তন, সূক্ষ্ম অঙ্কে করেছে গণন পণ্ডিতেরা লক্ষ কোটি ক্রোশ দূর হতে দুর্লক্ষ্য আলোতে। আপনার পানে চাই, লেশমাত্র পরিচয় নাই। এ কি কোনো দৃশ্যাতীত জ্যোতি। কোন্ অজানারে ঘিরি এই অজানার নিত্য গতি। বহুযুগে বহুদূরে স্মৃতি আর বিস্মৃতি-বিস্তার, যেন বাষ্পপরিবেশ তার ইতিহাসে পিণ্ড বাঁধে রূপে রূপান্তরে। "আমি' উঠে ঘনাইয়া কেন্দ্র-মাঝে অসংখ্য বৎসরে। সুখদুঃখ ভালোমন্দ রাগদ্বেষ ভক্তি সখ্য স্নেহ এই নিয়ে গড়া তার সত্তাদেহ; এরা সব উপাদান ধাক্কা পায়, হয় আবর্তিত, পুঞ্জিত, নর্তিত। এরা সত্য কী যে বুঝি নাই নিজে। বলি তারে মায়া-- যাই বলি শব্দ সেটা, অব্যক্ত অর্থের উপচ্ছায়া। তার পরে ভাবি, এ অজ্ঞেয় সৃষ্টি "আমি' অজ্ঞেয় অদৃশ্যে যাবে নাবি। অসীম রহস্য নিয়ে মুহূর্তের নিরর্থকতায় লুপ্ত হবে নানারঙা জলবিম্বপ্রায়, অসমাপ্ত রেখে যাবে তার শেষকথা আত্মার বারতা। তখনো সুদূরে ঐ নক্ষত্রের দূত ছুটাবে অসংখ্য তার দীপ্ত পরমাণুর বিদ্যুৎ অপার আকাশ-মাঝে, কিছুই জানি না কোন্ কাজে। বাজিতে থাকিবে শূন্যে প্রশ্নের সুতীব্র আর্তস্বর, ধ্বনিবে না কোনোই উত্তর।