তখন বয়স ছিল কাঁচা; কতদিন মনে মনে এঁকেছি নিজের ছবি, বুনো ঘোড়ার পিঠে সওয়ার, জিন নেই, লাগাম নেই, ছুটেছি ডাকাত-হানা মাঠের মাঝখান দিয়ে ভরসন্ধ্যেবেলায়; ঘোড়ার খুরে উড়ছে ধুলো ধরণী যেন পিছু ডাকছে আঁচল দুলিয়ে। আকাশে সন্ধ্যার প্রথম তারা দূরে মাঠের সীমানায় দেখা যায় একটিমাত্র ব্যগ্র বিরহী আলো একটি কোন্ ঘরে নিদ্রাহীন প্রতীক্ষায়। যে ছিল ভাবীকালে আগে হতে মনের মধ্যে ফিরছিল তারি আবছায়া, যেমন ভাবী আলোর আভাস আসে ভোরের প্রথম কোকিল-ডাকা অন্ধকারে। তখন অনেকখানি সংসার ছিল অজানা, আধ্জানা। তাই অপরূপের রাঙা রঙটা মনের দিগন্ত রেখেছিলে রাঙিয়ে; আসন্ন ভালোবাসা এনেছিল অঘটন-ঘটনার স্বপ্ন। তখন ভালোবাসার যে কল্পরূপ ছিল মনে তার সঙ্গে মহাকাব্যযুগের দুঃসাহসের আনন্দ ছিল মিলিত। এখন অনেক খবর পেয়েছি জগতের, মনে ঠাওরেছি সংসারের অনেকটাই মার্কামারা খবরের মালখানা। মনের রসনা থেকে অজানার স্বাদ গেছে মরে, অনুভবে পাইনে ভালোবাসায় সম্ভবের মধ্যে নিয়তই অসম্ভব, জানার মধ্যে অজানা, কথার মধ্যে রূপকথা। ভুলেছি প্রিয়ার মধ্যে আছে সেই নারী, যে থাকে সাত সমুদ্রের পারে, সেই নারী আছে বুঝি মায়ার ঘুমে, যার জন্যে খুঁজতে হবে সোনার কাঠি।
"কে নিবি গো কিনে আমায়, কে নিবি গো কিনে?" পসরা মোর হেঁকে হেঁকে বেড়াই রাতে দিনে। এমনি কবে হায়, আমার দিন যে চলে যায়, মায়ার 'পরে বোঝা আমার বিষম হল দায়। কেউ বা আসে, কেউ বা হাসে, কেউ বা কেঁদে চায়। মধ্যদিনে বেড়াই রাজার পাষাণ-বাঁধা পথে, মুকুট-মাথে অস্ত্র-হাতে রাজা এল রথে। বললে হাতে ধরে, "তোমায় কিনব আমি জোরে।" জোর যা ছিল ফুরিয়ে গেল টানাটানি করে। মুকুট-মাথে ফিরল রাজা সোনার রথে চড়ে। রুদ্ধ্ব দ্বারের সমুখ দিয়ে ফিরতেছিলেম গলি। দুয়ার খুলে বৃদ্ধ এল হাতে টাকার থলি। করলে বিবেচনা, বললে, "কিনব দিয়ে সোনা।" উজাড় করে দিয়ে থলি করলে আনাগোনা। বোঝা মাথায় নিয়ে কোথায় গেলেম অন্যমনা। সন্ধ্যাবেলায় জ্যোৎস্না নামে মুকুল-ভরা গাছে। সুন্দরী সে বেরিয়ে এল বকুলতলার কাছে। বললে কাছে এসে, "তোমায় কিনব আমি হেসে।" হাসিখানি চোখের জলে মিলিয়ে এল শেষে; ধীরে ধীরে ফিরে গেল বনছায়ার দেশে। সাগরতীরে রোদ পড়েছে ঢেউ দিয়েছে জলে, ঝিনুক নিয়ে খেলে শিশু বালুতটের তলে। যেন আমায় চিনে বললে, "অমনি নেব কিনে।" বোঝা আমার খালাস হল তখনি সেইদিনে। খেলার মুখে বিনামূল্যে নিল আমায় জিনে।