দেহের মধ্যে বন্দী প্রাণের ব্যাকুল চঞ্চলতা দেহের দেহলীতে জাগায় দেহের অতীত কথা। খাঁচার পাখি যে বাণী কয় সে তো কেবল খাঁচারি নয়, তারি মধ্যে করুণ ভাষায় সুদূর অগোচর বিস্মরণের ছায়ায় আনে অরণ্য মর্মর। চোখের দেখা নয় তো কেবল দেখারি জালবোনা কোন্ অলক্ষ্যে ছাড়িয়ে সে যায় সকল দেখাশোনা। শীতের রৌদ্রে মাঠের শেষে দেশ-হারানো কোন্ সে দেশে বসুন্ধরা তাকিয়ে থাকে নিমেষ-হারা চোখে দিগ্বলয়ের ইঙ্গিত-লীন উধাও কল্পলোকে। ভালোমন্দে বিকীর্ণ এই দীর্ঘ পথের বুকে রাত্র-দিনের যাত্রা চলে কত দুঃখে সুখে। পথের লক্ষ্য পথ-চলাতেই শেষ হবে কি? আর কিছু নেই? দিগন্তে যার স্বর্ণ লিখন, সংগীতের আহ্বান, নিরর্থকের গহ্বরে তার হঠাৎ অবসান? নানা ঋতুর ডাক পড়ে যেই মাটির গহন তলে চৈত্রতাপে, মাঘের হিমে, শ্রাবণ বৃষ্টিজলে স্বপ্ন দেখে বীজ সেখানে অভাবিতের গভীর টানে, অন্ধকারে এই যে ধেয়ান স্বপ্নে কি তার শেষ? উষার আলোয় ফুলের প্রকাশ, নাই কি সে উদ্দেশ?
বাঁখারির বেড়া দেওয়া ভূমি; হেথা করি ঘোরাফেরা সারাক্ষণ আমি-দিয়ে ঘেরা বর্তমানে। মন জানে এ মাটি আমারি, যেমন এ শালতরুসারি বাঁধে নিজ তলবীথি শিকড়ের গভীর বিস্তারে দূর শতাব্দীর অধিকারে। হেথা কৃষ্ণচূড়াশাখে ঝরে শ্রাবণের বারি সে যেন আমারি-- ভোরে ঘুমভাঙা আলো, রাত্রে তারাজ্বলা অন্ধকার, যেন সে আমারি আপনার এ মাটির সীমাটুকু মাঝে। আমার সকল খেলা, সব কাজে, এ ভূমি জড়িত আছে শাশ্বতের যেন সে লিখন। হঠাৎ চমক ভাঙে নিশীথে যখন সপ্তর্ষির চিরন্তন দৃষ্টিতলে, ধ্যানে দেখি, কালের যাত্রীর দল চলে যুগে যুগান্তরে। এই ভূমিখণ্ড-'পরে তারা এল, তারা গেল কত। তারাও আমারি মতো এ মাটি নিয়েছে ঘেরি-- জেনেছিল, একান্ত এ তাহাদেরি। কেহ আর্য কেহ বা অনার্য তারা, কত জাতি নামহীন, ইতিহাসহারা। কেহ হোমাগ্নিতে হেথা দিয়েছিল হবির অঞ্জলি, কেহ বা দিয়েছে নরবলি। এ মাটিতে একদিন যাহাদের সুপ্তচোখে জাগরণ এনেছিল অরুণ-আলোকে বিলুপ্ত তাদের ভাষা। পরে পরে যারা বেঁধেছিল বাসা, সুখে দুঃখে জীবনের রসধারা মাটির পাত্রের মতো প্রতি ক্ষণে ভরেছিল যারা এ ভূমিতে, এরে তারা পারিল না কোনো চিহ্ন দিতে। আসে যায় ঋতুর পর্যায়, আবর্তিত অন্তহীন রাত্রি আর দিন; মেঘরৌদ্র এর 'পরে ছায়ার খেলেনা নিয়ে খেলা করে আদিকাল হতে। কালস্রোতে আগন্তুক এসেছি হেথায় সত্য কিম্বা দ্বাপরে ত্রেতায় যেখানে পড়ে নি লেখা রাজকীয় স্বাক্ষরের একটিও স্থায়ী রেখা। হায় আমি, হায় রে ভূস্বামী, এখানে তুলিছ বেড়া--উপাড়িছ হেথা যেই তৃণ এই মাটিতে সে-ই রবে লীন পুনঃ পুনঃ বৎসরে বৎসরে। তারপরে!-- এই ধূলি রবে পড়ি আমি-শূন্য চিরকাল-তরে।