ওগো, ভালো করে বলে যাও। বাঁশরি বাজায়ে যে কথা জানাতে সে-কথা বুঝায়ে দাও। যদি না বলিবে কিছু, তবে কেন এসে মুখপানে শুধু চাও! আজি অন্ধতামসী নিশি। মেঘের আড়ালে গগনের তারা সবগুলি গেছে মিশি। শুধু বাদলের বায় করি হায়-হায় আকূলিছে দশ দিশি। আমি কুন্তল দিব খুলে। অঞ্চলমাঝে ঢাকিব তোমায় নিশীথনিবিড় চুলে। ছুটি বাহুপাশে বাঁধি নত মুখখানি বক্ষে লইব তুলে। সেথা নিভৃতনিলয়সুখে আপনার মনে বলে যেয়ো কথা মিলনমুদিত বুকে, আমি নয়ন মুদিয়া শুনিব কেবল চাহিব না মুখে মুখে। যবে ফুরাবে তোমার কথা যে যেমন আছি রহিব বসিয়া চিত্রপুতলি যথা। শুধু শিয়রে দাঁড়ায়ে করে কানাকানি মর্মর তরুলতা। শেষে রজনীর অবসানে অরুণ উদিলে, ক্ষণেকের তরে চাব দুঁহু দোঁহা-পানে। ধীরে ঘরে যাব ফিরে দোঁহে দুই পথে জলভরা দু'নুয়ানে। তবে ভালো করে বলে যাও। আঁখিতে বাঁশিতে যে কথা ভাষিতে সে কথা বুঝায়ে দাও। শুধু কম্পিত সুরে আধো ভাষা পূরে কেন এসে গান গাও!
আমি যারে ভালোবাসি সে ছিল এই গাঁয়ে, বাঁকা পথের ডাহিন পাশে, ভাঙা ঘাটের বাঁয়ে। কে জানে এই গ্রাম, কে জানে এর নাম, খেতের ধারে মাঠের পারে বনের ঘন ছায়ে-- শুধু আমার হৃদয় জানে সে ছিল এই গাঁয়ে। বেণুশাখারা আড়াল দিয়ে চেয়ে আকাশ-পানে কত সাঁঝের চাঁদ-ওঠা সে দেখেছে এইখানে। কত আষাঢ় মাসে ভিজে মাটির বাসে বাদলা হাওয়া বয়ে গেছে তাদের কাঁচা ধানে। সে-সব ঘনঘটার দিনে সে ছিল এইখানে। এই দিঘি, ওই আমের বাগান, ওই-যে শিবালয়, এই আঙিনা ডাক-নামে তার জানে পরিচয়। এই পুকুরে তারি, সাঁতার-কাটা বারি, ঘাটের পথরেখা তারি চরণ-লেখা-ময়। এই গাঁয়ে সে ছিল কে সেই জানে পরিচয়। এই যাহারা কলস নিয়ে দাঁড়ায় ঘাটে আসি এরা সবাই দেখেছিল তারি মুখের হাসি। কুশল পুছি তারে দাঁড়াত তার দ্বারে লাঙল কাঁধে চলছে মাঠে ওই-যে প্রাচীন চাষি। সে ছিল এই গাঁয়ে আমি যারে ভালোবাসি। পালের তরী কত-যে যায় বহি দখিনবায়ে, দূর প্রবাসের পথিক এসে বসে বকুলছায়ে। পারের যাত্রিদলে খেয়ার ঘাটে চলে, কেউ গো চেয়ে দেখে না ওই ভাঙা ঘাটের বাঁয়ে। আমি যারে ভালোবাসি সে ছিল এই গাঁয়ে।