তুমি যখন চলে গেলে তখন দুই-পহর-- সূর্য তখন মাঝ-গগনে, রৌদ্র খরতর। ঘরের কর্ম সাঙ্গ করে ছিলেম তখন একলা ঘরে, আপন-মনে বসে ছিলেম বাতায়নের 'পর। তুমি যখন চলে গেলে তখন দুই-পহর। চৈত্র মাসের নানা খেতের নানা গন্ধ নিয়ে আসতেছিল তপ্ত হাওয়া মুক্ত দুয়ার দিয়ে। দুটি ঘুঘু সারাটা দিন ডাকতেছিল শ্রান্তিবিহীন, একটি ভ্রমর ফিরতেছিল কেবল গুন্গুনিয়ে চৈত্র মাসের নানা খেতের নানা বার্তা নিয়ে। তখন পথে লোক ছিল না, ক্লান্ত কাতর গ্রাম। ঝাউশাখাতে উঠতেছিল শব্দ অবিশ্রাম। আমি শুধু একলা প্রাণে অতি সুদূর বাঁশির তানে গেঁথেছিলেম আকাশ ভ'রে একটি কাহার নাম। তখন পথে লোক ছিল না, ক্লান্ত কাতর গ্রাম। ঘরে ঘরে দুয়ার দেওয়া, আমি ছিলেম জেগে-- আবাঁধা চুল উড়তে ছিল উদাস হাওয়া লেগে। তটতরুর ছায়ার তলে ঢেউ ছিল না নদীর জলে, তপ্ত আকাশ এলিয়ে ছিল শুভ্র অলস মেঘে। ঘরে ঘরে দুয়ার দেওয়া, আমি ছিলেম জেগে। তুমি যখন চলে গেলে তখন দুই-পহর, শুষ্ক পথে দগ্ধ মাঠে রৌদ্র খরতর। নিবিড়-ছায়া বটের শাখে কপোত দুটি কেবল ডাকে একলা আমি বাতায়নে-- শূন্য শয়ন-ঘর। তুমি যখন গেলে তখন বেলা দুই-পহর।
পশ্চিমে শহর। তারি দূর কিনারায় নির্জনে দিনের তাপ আগলে আছে একটা অনাদৃত বাড়ি, চারি দিকে চাল পড়েছে ঝুঁকে। ঘরগুলোর মধ্যে চিরকালের ছায়া উপুড় হয়ে পড়ে, আর চিরবন্দী পুরাতনের একটা গন্ধ। মেঝের উপর হলদে জাজিম, ধারে ধারে ছাপ-দেওয়া বন্দুক-ধারী বাঘ-মারা শিকারীর মূর্তি। উত্তর দিকে সিসুগাছের তলা দিয়ে চলেছে সাদা মাটির রাস্তা, উড়ছে ধুলো খররৌদ্রের গায়ে হালকা উড়নির মতো। সামনের চরে গম অড়র ফুটি তরমুজের খেত, দূরে ঝক্মক্ করছে গঙ্গা, তার মাঝে মাঝে গুণ-টানা নৌকো কালির আঁচড়ে আঁকা ছবি যেন। বারান্দায় রুপোর-কাঁকন-পরা ভজিয়া গম ভাঙছে জাঁতায়, গান গাইছে একঘেয়ে সুরে, গির্ধারী দারোয়ান অনেক ক্ষণ ধরে তার পাশে বসে আছে জানি না কিসের ওজরে। বুড়ো নিমগাছের তলায় ইঁদারা, গোরু দিয়ে জল টেনে তোলে মালী, তার কাকুধ্বনিতে মধ্যাহ্ন সকরুণ, তার জলধারায় চঞ্চল ভুট্টার খেত। গরম হাওয়ায় ঝাপসা গন্ধ আসছে আমের বোলের, খবর আসছে মহানিমের মঞ্জরীতে মৌমাছির বসেছে মেলা। অপরাহ্নে শহর থেকে আসে একটি পরবাসী মেয়ে, তাপে কৃশ পাণ্ডুবর্ণ বিষণ্ন তার মুখ, মৃদুস্বরে পড়িয়ে যায় বিদেশী কবির কবিতা। নীল রঙের জীর্ণ চিকের ছায়া-মিশানো অস্পষ্ট আলোয় ভিজে খস্খসের গন্ধের মধ্যে প্রবেশ করে সাগরপারের মানবহৃদয়ের ব্যথা। আমার প্রথমযৌবন খুঁজে বেড়ায় বিদেশী ভাষার মধ্যে আপন ভাষা, প্রজাপতি যেমন ঘুরে বেড়ায় বিলিতি মৌসুমি ফুলের কেয়ারিতে নানা বর্ণের ভিড়ে।