ও আমার অভিমানী মেয়ে ওরে কেউ কিছু বোলো না। ও আমার কাছে এসেছে, ও আমায় ভালো বেসেছে, ওরে কেউ কিছু বোলো না। এলোথেলো চুলগুলি ছড়িয়ে ওই দেখো সে দাঁড়িয়ে রয়েছে, নিমেষহারা আঁখির পাতা দুটি চোখের জলে ভরে এয়েছে। গ্রীবাখানি ঈষৎ বাঁকানো, দুটি হাতে মুঠি আছে চাপি, ছোটো ছোটো রাঙা রাঙা ঠোঁট ফুলে ফুলে উঠিতেছে কাঁপি। সাধিলে ও কথা কবে না, ডাকিলে ও আসিবে না কাছে, ও সবার 'পরে অভিমান করে আপ্না নিয়ে দাঁড়িয়ে শুধু আছে। কী হয়েছে কী হয়েছে বলে বাতাস এসে চুলিগুলি দোলায়; রাঙা ওই কপোলখানিতে রবির হাসি হেসে চুমো খায়। কচি হাতে ফুল দুখানি ছিল রাগ করে ঐ ফেলে দিয়েছে- পায়ের কাছে পড়ে পড়ে তারা মুখের পানে চেয়ে রয়েছে। আয় বাছা, তুই কোলে ব'সে বল্ কী কথা তোর বলিবার আছে, অভিমানে রাঙা মুখখানি আন দেখি তুই এ বুকের কাছে। ধীরে ধীরে আধো আধো বল্ কেঁদে কেঁদে ভাঙা ভাঙা কথা, আমায় যদি না বলিবি তুই কে শুনিবে শিশু-প্রাণের ব্যথা।
আছে, আছে স্থান! একা তুমি, তোমার শুধু একটি আঁটি ধান। নাহয় হবে, ঘেঁষাঘেঁষি, এমন কিছু নয় সে বেশি, নাহয় কিছু ভারী হবে আমার তরীখান-- তাই বলে কি ফিরবে তুমি আছে, আছে স্থান! এসো, এসো নায়ে! ধুলা যদি থাকে কিছু থাক্-না ধূলা পায়ে। তনু তোমার তনুলতা, চোখের কোণে চঞ্চলতা, সজলনীল-জলদ-বরন বসনখানি গায়ে-- তোমার তরে হবে গো ঠাঁই-- এসো এসো নায়ে। যাত্রী আছে নানা, নানা ঘাটে যাবে তারা কেউ কারো নয় জানা। তুমিও গো ক্ষণেক-তরে বসবে আমার তরী-'পরে, যাত্রা যখন ফুরিয়ে যাবে, মান্বে না মোর মানা-- এলে যদি তুমিও এসো, যাত্রী আছে নানা। কোথা তোমার স্থান? কোন্ গোলাতে রাখতে যাবে একটি আঁটি ধান? বলতে যদি না চাও তবে শুনে আমার কী ফল হবে, ভাবব ব'সে খেয়া যখন করব অবসান-- কোন্ পাড়াতে যাবে তুমি, কোথা তোমার স্থান?
যৌবন হচ্ছে জীবনে সেই ঋতুপরিবর্তনের সময় যখন ফুল ও ফসলের প্রচ্ছন্ন প্রেরণা নানা বর্ণে ও রূপে অকস্মাৎ বাহিরে প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে। কড়ি ও কোমল আমার সেই নবযৌবনের রচনা। আত্মপ্রকাশের একটা প্রবল আবেগ তখন যেন প্রথম উপলব্ধি করেছিলুম। মনে পড়ে তখনকার দিনে নিজের মনের একটা উদ্বেল অবস্থা। তখন আমার বেশভূষায় আবরণ ছিল বিরল। গায়ে থাকত ধুতির সঙ্গে কেবল একটা পাতলা চাদর, তার খুঁটোয় বাঁধা ভোরবেলায় তোলা একমুঠো বেলফুল, পায়ে একজোড়া চটি। মনে আছে থ্যাকারের দোকানে বই কিনতে গেছি কিন্তু এর বেশি পরিচ্ছন্নতা নেই, এতে ইংরেজ দোকানদারের স্বীকৃত আদবকায়দার প্রতি উপেক্ষা প্রকাশ হত। এই আত্মবিস্মৃত বেআইনী প্রমত্ততা কড়ি ও কোমলের কবিতায় অবাধে প্রকাশ পেয়েছিল। এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে রাখতে হবে এই রীতির কবিতা তখনো প্রচলিত ছিল না। সেইজন্যেই কাব্যবিশারদ প্রভৃতি সাহিত্যবিচারকদের কাছ থেকে কটুভাষায় ভর্ৎসনা সহ্য করেছিলুম। সে-সব যে উপেক্ষা করেছি অনায়াসে সে কেবল যৌবনের তেজে। আপনার মধ্যে থেকে যা প্রকাশ পাচ্ছিল, সে আমার কাছেও ছিল নূতন এবং আন্তরিক। তখন হেম বাঁড়ুজ্জে এবং নবীন সেন ছাড়া এমন কোনো দেশপ্রসিদ্ধ কবি ছিলেন না যাঁরা নূতন কবিদের কোনো-একটা কাব্যরীতির বাঁধা পথে চালনা করতে পারতেন। কিন্তু আমি তাঁদের সম্পূর্ণই ভুলে ছিলুম। আমাদের পরিবারের বন্ধু কবি বিহারীলালকে ছেলেবেলা থেকে জানতুম এবং তাঁর কবিতার প্রতি অনুরাগ আমার ছিল অভ্যস্ত। তাঁর প্রবর্তিত কবিতার রীতি ইতিপূর্বেই আমার রচনা থেকে সম্পূর্ণ স্খলিত হয়ে গিয়েছিল। বড়োদাদার স্বপ্নপ্রয়াণের আমি ছিলুম অত্যন্ত ভক্ত, কিন্তু তাঁর বিশেষ কবিপ্রকৃতির সঙ্গে আমার বোধ হয় মিল ছিল না, সেইজন্য ভালোলাগা সত্ত্বেও তাঁর প্রভাব আমার কবিতা গ্রহণ করতে পারে নি। তাই কড়ি ও কোমলের কবিতা মনের অন্তঃস্তরের উৎসের থেকে উছলে উঠেছিল। তার সঙ্গে বাহিরের কোনো মিশ্রণ যদি ঘটে থাকে তো সে গৌণভাবে। এই আমার কবিতা প্রথম কবিতার বই যার মধ্যে বিষয়ের বৈচিত্র৻ এবং বহির্দৃষ্টিপ্রবণতা দেখা দিয়েছে। আর প্রথম আমি সেই কথা বলেছি যা পরবর্তী আমার কাব্যের অন্তরে অন্তরে বারবার প্রবাহিত হয়েছে-- মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই,-- বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি সে আমার নয়।