এ কথা মানিব আমি, এক হতে দুই কেমনে যে হতে পারে জানি না কিছুই। কেমনে যে কিছু হয়, কেহ হয় কেহ, কিছু থাকে কোনোরূপে, কারে বলে দেহ, কারে বলে আত্মা মন, বুঝিতে না পেরে চিরকাল নিরখিব বিশ্বজগতেরে নিস্তব্ধ নির্বাক্ চিত্তে। বাহিরে যাহার কিছুতে নারিব যেতে আদি অন্ত তার, অর্থ তার, তত্ত্ব তার, বুঝিব কেমনে নিমেষের তরে? এই শুধু জানি মনে সুন্দর সে, মহান সে, মহাভয়ংকর, বিচিত্র সে, অজ্ঞেয় সে, মম মনোহর। ইহা জানি, কিছুই না জানিয়া অজ্ঞাতে নিখিলের চিত্তস্রোত ধাইছে তোমাতে।
দূর মন্দিরে সিন্ধুকিনারে পথে চলিয়াছ তুমি। আমি তরু মোর ছায়া দিয়ে তারে মৃত্তিকা তার চুমি। হে তীর্থগামী, তব সাধনার অংশ কিছু-বা রহিল আমার, পথপাশে আমি তব যাত্রার রহিব সাক্ষীরূপে। তোমার পূজায় মোর কিছু যায় ফুলের গন্ধধূপে। তব আহ্বানে বরণ করিয়া নিয়েছি দুর্গমেরে। ক্লান্তি কিছু-বা নিলাম হরিয়া মোর অঞ্চল-ঘেরে। যা ছিল কঠোর, যাহা নিষ্ঠুর তার সাথে কিছু মিলাই মধুর, যা ছিল অজানা, যাহা ছিল দূর আমি তারি মাঝে থেকে দিনু পথ-'পরে শ্যাম অক্ষরে জানার চিহ্ন এঁকে। মোর পরিচয়ে তোমার পথের কিছু রহে পরিচয়। তব রচনায় তব ভকতের কিছু বাণী মিশে রয়। তোমার মধ্যদিবসের তাপে আমার স্নিগ্ধ কিশলয় কাঁপে, মোর পল্লব সে মন্ত্র জাপে গভীর যা তব মনে, মোর ফলভার মিলানু তোমার সাধনফলের সনে। বেলা চলে যাবে, একদা যখন ফুরাবে যাত্রা তব, শেষ হবে যবে মোর প্রয়োজন হেথাই দাঁড়ায়ে রব। এই পথখানি রবে মোর প্রিয়, এই হবে মোর চিরবরণীয়, তোমারি স্মরণে রব স্মরণীয়, না মানিব পরাভব। তব উদ্দেশে অর্পিব হেসে যা-কিছু আমার সব।
আমার দিনের শেষ ছায়াটুকু মিশাইলে মূলতানে-- গুঞ্জন তার রবে চিরদিন, ভুলে যাবে তার মানে। কর্মক্লান্ত পথিক যখন বসিবে পথের ধারে এই রাগিণীর করুণ আভাস পরশ করিবে তারে, নীরবে শুনিবে মাথাটি করিয়া নিচু; শুধু এইটুকু আভাসে বুঝিবে, বুঝিবে না আর কিছু-- "বিস্মৃত যুগে দুর্লভ ক্ষণে বেঁচেছিল কেউ বুঝি, আমরা যাহার খোঁজ পাই নাই তাই সে পেয়েছে খুঁজি।'