কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক। মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ। ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে, মুক্তবেণী পিঠের 'পরে লোটে। কালো? তা সে যতই কালো হোক দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ। ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই, শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই। আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু। কালো? তা সে যতই কালো হোক দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ। পুবে বাতাস এল হঠাৎ ধেয়ে, ধানের খেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ। আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা, মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ। আমার পানে দেখলে কিনা চেয়ে আমিই জানি আর জানে সে মেয়ে। কালো? তা সে যতই কালো হোক দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ। এমনি করে কালো কাজল মেঘ জ্যৈষ্ঠ মাসে আসে ঈশান কোণে। এমনি করে কালো কোমল ছায়া আষাঢ় মাসে নামে তমাল-বনে। এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে হঠাৎ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে। কালো? তা সে যতই কালো হোক দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ। কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, আর যা বলে বলুক অন্য লোক। দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ। মাথার 'পরে দেয় নি তুলে বাস, লজ্জা পাবার পায় নি অবকাশ। কালো? তা সে যতই কালো হোক দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
চৈত্রের রাতে যে মাধবীমঞ্জরী ঝরে গেল, তারে কেন লও সাজি ভরি। সে শুধিছে তার ধুলায় চরম দেনা, আজ বাদে কাল যাবে না তো তারে চেনা। মরুপথে যেতে পিপাসার সম্বল গাগরি হইতে চলকিয়া পড়ে জল, সে জলে বালুতে ফল কি ফলাতে পারো? সে জলে কি তাপ মিটিবে কখনো কারো? যাহা দেওয়া নহে, যাহা শুধু অপচয়, তারে নিতে গেলে নেওয়া অনর্থ হয়। ক্ষতির ধনেরে ক্ষয় হতে দেওয়া ভালো, কুড়াতে কুড়াতে শুকায়ে সে হয় কালো। হায় গো ভাগ্য, ক্ষণিক করুণাভরে যে হাসি যে ভাষা ছড়ায়েছ অনাদরে, বক্ষে তাহারে সঞ্চয় করে রাখি-- ধুলা ছাড়া তার কিছুই রয় না বাকি। নিমেষে নিমেষে ফুরায় যাহার দিন চিরকাল কেন বহিব তাহার ঋণ? যাহা ভুলিবার তাহা নহে তুলিবার, স্বপ্নের ফুলে কে গাঁথে গলার হার! প্রতি পলকের নানা দেনাপাওনায় চলতি মেঘের রঙ বুলাইয়া যায় জীবনের স্রোতে; চলতরঙ্গতলে ছায়ার লেখন আঁকিয়া মুছিয়া চলে শিল্পের মায়া--নির্মম তার তুলি আপনার ধন আপনি সে যায় ভুলি। বিস্মৃতিপটে চিরবিচিত্র ছবি লিখিয়া চলেছে ছায়া-আলোকের কবি। হাসিকান্নার নিত্য-ভাসান খেলা বহিয়া চলেছে বিধাতার অবহেলা। নহে সে কৃপণ, রাখিতে যতন নাই, খেলাপথে তার বিঘ্ন জমে না তাই। মানো সেই লীলা, যাহা যায় যাহা আসে পথ ছাড়ো তারে অকাতরে অনায়াসে। আছে তবু নাই, তাই নাই তার ভার; ছেড়ে যেতে হবে, তাই তো মূল্য তার। স্বর্গ হইতে যে সুধা নিত্য ঝরে সে শুধু পথের, নহে সে ঘরের তরে। তুমি ভরি লবে ক্ষণিকের অঞ্জলি, স্রোতের প্রবাহ চিরদিন যাবে চলি।
আমি হাল ছাড়লে তবে তুমি হাল ধরবে জানি যা হবার আপনি হবে মিছে এই টানাটানি। ছেড়ে দে দে গো ছেড়ে, নীরবে যা তুই হেরে, যেখানে আছিস বসে বসে থাক্ ভাগ্য মানি। আমার এই আলোগুলি নেবে আর জ্বালিয়ে তুলি, কেবলি তারি পিছে তা নিয়েই থাকি ভুলি। এবার এই আঁধারেতে রহিলাম আঁচল পেতে, যখনি খুশি তোমার নিয়ো সেই আসনখানি।