কিন্তু ইহা বলিয়া রাখি,ভাবুক লোকদিগের নিজের প্রতি মনোযোগ দিবার যেমন অল্প অবসর ও আবশ্যক আছে, এমন আর কাহারো নহে। যাহাদের পরের সহিত মিশিতে হয় তাহাদের যেমন চব্বিশ ঘন্টা নিজের চর্চ্চা করিতে হয়, এমন আর কাহাকেও না। তাহাদের দিনরাত্রি নিজেকে মাজিতে-ঘষিতে সাজাইতে-গোজাইতে হয়। পরের চোখের কাছে নিজেকে উপাদেয় করিয়া উপহার দিতে হয়। এইরূপে যাহারা পরের সহিত মেশে,নিজের সহিত তাহাদের অধিকতর মিশিতে হয়। ইহারাই যথার্থ আত্মম্ভরি। ভাবুকগণ কবিগণ সর্বদাই নিজেকে ভুলিয়া থাকেন। কারণ তাঁহাদের নিজেকে মনে করাইয়া দিবার জন্য পর কেহ উপস্থিত থাকে না। নিজের সহিত ব্যতীত আর কাহারো সহিত ইহারা ভাল করিয়া মেশেন না বলিয়া ইহারা নিজের কথা ভাবেন না। ইঁহারাই যথার্থ আত্মময় আত্ম-বিস্মৃত।
সকলেই কিছু নিজের মাথা হইতে গড়িতে পারে না, এই জন্যই ছাঁচের আবশ্যক হয়। সকলেই কিছু কবি নহে, এই জন্য অলঙ্কার শাস্ত্রের প্রয়োজন। গানের গলা অনেকেরই আছে, কিন্তু গানের প্রতিভা অল্প লোকেরই আছে, এই জন্যই অনেকেই গান গাহিতে পারেন না, রাগ রাগিণী গাহিতে পারেন। হৃদয়ের এমন একটা স্বভাব আছে, যে, যখনি তাহার ফুলবাগানে বসন্তের বাতাস বয় তখনি তার গাছে গাছে ডালে ডালে আপনি কুঁড়ি ধরে, আপনি ফুল ফুটিয়া উঠে। কিন্তু যার প্রাণে ফুলবাগান নাই, যার প্রাণে বসন্তের বাতাস বয় না, সে কি করে? সে প্যাটার্ণ কিনিয়া চোখে চশমা দিয়া পশমের ফুল তৈরি করে।
বর্ত্তমান সভ্যতার প্রাণপণ চেষ্টা এই যে, কিছুই ফেলা না যায়, সকলই কাজে লাগে। মনোবিজ্ঞান একটা ক্ষুদ্র বালকের, একটা বদ্ধ পাগলের, প্রত্যেক ক্ষুদ্রতম চিন্তা খেয়াল মনোভাব সঞ্চয় করিয়া রাখিয়া দেয় -- কাজে লাগিবে। সমাজ-বিজ্ঞান, শিশু সমাজের, অসভ্য সমাজের, প্রত্যেক ক্ষুদ্র অনুষ্ঠান, অর্থহীন প্রথা, পুঁথিতে জমা করিয়া রাখিতেছে - কাজে লাগিবে । এখনকার কবিরাও এমন সকল ক্ষুদ্র যৎসামান্য বিষয়গুলিকে কবিতায় পরিণত করেন, যাহা প্রাচীন লোকেরা গদ্যেরও অনুপযুক্ত মনে করিতেন। এখনকার শিল্পেও, যাহা সাধারণ লোকে অনাবশ্যক পুরাণ' গলিত বলিয়া ফেলিয়া দেয়, তাহাও একটা না একটা খাটিয়া যাইতেছে।