আণ্ডেস জাহাজ,  ২ নভেম্বর, ১৯২৪


 

কৃতজ্ঞ (kritogyo)


বলেছিনু "ভুলিব না' যবে তব ছলছল আঁখি

নীরবে চাহিল মুখে।    ক্ষমা কোরো যদি ভুলে থাকি।

সে যে বহুদিন হল।    সেদিনের চুম্বনের 'পরে

কত নববসন্তের মাধবীমঞ্জরী থরে থরে

শুকায়ে পড়িয়া গেছে; মধ্যাহ্নের কপোতকাকলি

তারি 'পরে ক্লান্ত ঘুম চাপা দিয়ে এল গেল চলি

কতদিন ফিরে ফিরে।    তব কালো নয়নের দিঠি

মোর প্রাণে লিখেছিল প্রথম প্রেমের সেই চিঠি

লজ্জাভয়ে; তোমার সে হৃদয়ের স্বাক্ষরের 'পরে

চঞ্চল আলোকছায়া কত কাল প্রহরে প্রহরে

বুলায়ে গিয়েছে তুলি, কত সন্ধ্যা দিয়ে গেছে এঁকে

তারি 'পরে সোনার বিস্মৃতি, কত রাত্রি গেছে রেখে

অস্পষ্ট রেখার জালে আপনার স্বপনলিখন

তাহারে আচ্ছন্ন করি।    প্রতিমুহূর্তটি প্রতিক্ষণ

বাঁকাচোরা নানা চিত্রে চিন্তাহীন বালকের প্রায়

আপনার স্মৃতিলিপি চিত্তপটে এঁকে এঁকে যায়,

লুপ্ত করি পরস্পরে বিস্মৃতির জাল দেয় বুনে।

সেদিনের ফাল্গুনের বাণী যদি আজি এ ফাল্গুনে

ভুলে থাকি, বেদনার দীপ হতে কখন নীরবে

অগ্নিশিখা নিবে গিয়ে থাকে যদি, ক্ষমা কোরো তবে।

 

তবু জানি, একদিন তুমি দেখা দিয়েছিলে বলে

গানের ফসল মোর এ জীবনে উঠেছিল ফলে,

আজও নাই শেষ; রবির আলোক হতে একদিন

ধ্বনিয়া তুলেছে তার মর্মবাণী, বাজায়েছে বীন

তোমার আঁখির আলো।    তোমার পরশ নাহি আর,

কিন্তু কী পরশমণি রেখে গেছ অন্তরে আমার --

বিশ্বের অমৃতছবি আজিও তো দেখা দেয় মোরে  

ক্ষণে ক্ষণে -- অকারণ আনন্দের সুধাপাত্র ভ'রে

আমারে করায় পান। ক্ষমা কোরো যদি ভুলে থাকি।

তবু জানি একদিন তুমি মোরে নিয়েছিলে ডাকি

হৃদিমাঝে; আমি তাই আমার ভাগ্যেরে ক্ষমা করি --

যত দুঃখে যত শোকে দিন মোর দিয়েছে সে ভরি

সব ভুলে গিয়ে। পিপাসার জলপাত্র নিয়েছে সে

মুখ হতে, কতবার  ছলনা করেছে হেসে হেসে,

ভেঙেছে বিশ্বাস, অকস্মাৎ ডুবায়েছে ভরা তরী

তীরের সম্মুখে নিয়ে এসে -- সব তার ক্ষমা করি।

আজ তুমি আর নাই, দূর হতে গেছ তুমি দূরে,

বিধুর হয়েছে সন্ধ্যা মুছে-যাওয়া তোমার সিন্দুরে,

সঙ্গীহীন এ জীবন শূন্যঘরে হয়েছে শ্রীহীন,

সব মানি -- সব চেয়ে মানি তুমি ছিলে একদিন।

 

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •