বালক, অগ্রহায়ণ ১২৯২


 

শিউলিফুলের গাছ (shiuliphuler gachh)


আমি সমস্ত দিন কেবল টুপ্‌টাপ্‌ করিয়া ফুল ফেলিতেছি ; আমার তো আর কোনো কাজ নাই। আমার প্রাণ যখন পরিপূর্ণ হইয়া উঠে, আমার সাদা সাদা হাসিগুলি মধুর অশ্রুজলের মতো আমি বর্ষণ করিতে থাকি।

 

                        আমার চারি দিকে কী শোভা! কী আলো! আমার শাখায় শাখায় পাতায় পাতায় সূর্যের কিরণ নাচিতেছে। বীণার তারের উপর মধুর সংগীত যেমন আপনার আনন্দে থর্‌থর্‌ করিয়া কাঁপিয়া উঠে, স্বর্গ হইতে নামিয়া আসে, এবং কাঁপিতে কাঁপিতে স্বর্গেই চলিয়া যায় ; আমার পাতায় পাতায় প্রভাতের আলো তেমনি করিয়া কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছে, চমক খাইয়া আকাশে ঠিক্‌রিয়া পড়িতেছে, সেই আলোকের চম্পক-অঙ্গুলি স্পর্শে আমার প্রাণের ভিতরেও ঝিন্‌ঝিন্‌ করিয়া বাজিয়া উঠিতেছে, কাঁদিয়া উঠিতেছে-- আমি আপনাকে আর রাখিতে পারিতেছি না-- বিহ্বল হইয়া আমার ফুলগুলি ঝরিয়া পড়িতেছে।

 

                        বাতাস আসিয়াছে। ভোরের বেলায় জাগিয়া উঠিয়াই আমাকে তাহার মনে পড়িয়াছে। রাত্রে সে স্বপ্ন দেখিয়া মাঝে মাঝে জাগিয়া আমার কোলের উপর আসিয়া আবার ঘুমাইয়া পড়ে। আমার কোমল পল্লবের স্তরের মধ্যে আসিয়া সে আরাম পায়। আধো-আধো স্বরে সে আমাকে ঘিরিয়া ঘিরিয়া কথা কহে, সে তাহার খেলার গল্প করে, আকাশের মেঘ ও সমুদ্রের ঢেউয়ের কাহিনী বলে-- বলিতে বলিতে ভুলিয়া যায়, চলিয়া যায়-- আবার কখন আপন মনে ফিরিয়া আসে। সে যখন দূর হইতে আসিয়া দুই-একটা কথা বলিয়া আমার পাশ দিয়া চলিয়া যায়, তাহার উড়ন্ত আঁচলটি আমার গায়ে একটু ঠেকিয়া অমনি উড়িয়া যায়, আমার সমস্ত ডালপালা চঞ্চল হইয়া উঠে, আমার ফুলগুলি তাহার পিছন পিছন উড়িয়া যায়, স্নেহভরে ভূমিতে পড়িয়া যায়।

 

                        দুপুরবেলা চারি দিক নিঝুম হইয়া গেলে একটি পাখি আসিয়া আমার পাতার মধ্যে বসিয়া এক সুরে ডাকিতে থাকে। তাহার সেই সুর শুনিয়া ছায়াখানি আমার তলায় ঘুমাইয়া পড়ে। বাতাস আর চলিতে পারে না। মেঘের টুকরো স্বপ্নের মতো ভাসিয়া যায়। দূর হইতে রাখালের বাঁশির স্বর মিলাইয়া আসে। ঘাসের ভিতরে বেগুনি ফুলগুলি বৃন্তসুদ্ধ মাথা হেঁট করিয়া থাকে। দুই-একটা করিয়া আমার ফুল যেন ভুলিয়া ঝরিয়া পড়ে। তাহারাও সেই পাখির এক সুরে এক গানের মতো, সমস্ত দুপুরবেলা একভাবে একছন্দে একটির পরে একটি করিয়া ঝরিতে থাকে-- ভূমিতে পড়িয়া মরিতে থাকে-- আপনার মনে মিলাইয়া যায়।

 

                        সন্ধ্যার কনক-উপকূল ছাপাইয়া অন্ধকার যখন জগৎ ভাসাইয়া দেয়, আমি তখন আকাশে চাহিয়া থাকি। আমার মনে হয় আমার আজন্মকালের ঝরা ফুলগুলি আকাশে তারা হইয়া উঠিয়াছে। উহাদের মধ্যেও দু-একটা কখনো কখনো ঝরিয়া আসে, বোধ করি আমারই তলায় আসিয়া পড়ে, সকালে তাহার উপরে শিশির পড়িয়া থাকে। এইরূপ স্বপ্ন ভাবিতে ভাবিতে আমি ঘুমাইয়া পড়ি এবং ঘুমাইতে ঘুমাইতে স্বপ্ন দেখি; নিশীথের মাধুরী আমাকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখে।  আমি স্বপ্নে অনুভব করিতে থাকি ধীরে ধীরে আমার কুঁড়িগুলি আমার সর্বাঙ্গে পুলকের মতো ছাইয়া উঠিতেছে। আধঘুমঘোরে শুনিতে পাই আমার সন্ধ্যাবেলাকার ফোটা

 

ফুলগুলি টুপ্‌টাপ্‌ করিয়া অন্ধকারে ঝরিয়া পড়িতেছে।

 

                        আমি সমস্ত দিনরাত্রি এই নীল আকাশের তলে দাঁড়াইয়া আছি-- আমি চলিতে পারি না, খুঁজিতে পারি না, কোথায় কী আছে সকল দেখিতে পাই না।

 

আমি কেবল আকাশের গুটিকত তারা চিনিয়া রাখিয়াছি, আর কাননের গুটিকতক গাছ দেখিতে পাই, তাহারা প্রভাতের আনন্দে আমারই মতো কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠে। আমার কাছে দূর বন হইতে ফুলের গন্ধ আসে, কিন্তু সে পুল আমি দেখিতে পাই না। পল্লবের মর্মর শুনিতে পাই কিন্তু কোথায় সে ছায়াময় বন! শ্রভ্র ক্ষীণ মেঘ আকাশের উপর দিয়া ভাসিয়া যায়-- কিন্তু কোথায় সে যায়! যে পাখি অনেক দূর হইতে উড়িয়া আমার ডালে আসিয়া বসে সে কেন আমাকে জগতের সকল কথা বলিয়া যায় না!

 

                        আমি এক জায়গায় দাঁড়াইয়া থাকি-- যাহার জন্য আমার ফুল ফুটিতেছে মনের সাধ মিটাইয়া তাহাকে খুঁজিয়া বেড়াইতে পারি না। এইজন্য আমি সমস্তদিন ফুল ফেলিয়া দিই-- আমি দাঁড়াইয়া থাকি কিন্তু আমার সুগন্ধ আমার প্রাণের আশা ঘুরিয়া বেড়ায়। আমার ফুলগুলি আমি বাঁধিয়া রাখি না, তাহারা উড়িয়া যায়। তাহাদের আমি জগতে পাঠাইয়া দিই, আমার আনন্দের বার্তা তাহারা দূরে গিয়া প্রচার করিয়া আসে। আমি আমার অজানা অচেনাকে ফুলের অক্ষরে চিঠি

 

লিখিয়া পাঠাই। নিশ্চয় তাহার হাতে গিয়া ,পৌঁছায়, নহিলে আমার মনের ভার লাঘব হয় কেন? আমি নীলকাশে চাহিয়া উদ্দেশে আমার প্রিয়তমের চরণে অনুক্ষণ অঞ্জলিপূর্ণ পুল ঢালিয়া দিই, আমি যেখানে যাইতে পারি না, আমার ফুলেরা সেখানে চলিয়া যায়।

 

                        ছোটো মেয়েটি আমার তলা হইতে অবহেলা অমনি একমুঠো ফুল কুড়াইয়া লয়, মাথায় দুটো ফুল গুঁজিয়া চলিয়া যায়। কোথায় কোন্‌ নদীর ধারে কোন্‌ ছোটো কুটিরে তাহার ছোটো ছোটো সুখদুঃখের মধ্যে আমার ফুলের গন্ধ মিশাইতে থাকে। বৃদ্ধ সকালে সাজি করিয়া আমার ফুল দেবতার চরণে অর্পণ করে, তাহার ভক্তির সহিত আমার ফুলের গন্ধ আকাশে উঠিতে থাকে।

 

                        আমি প্রতিদিন সকালে যে আনন্দপূর্ণ সূর্যালোক, স্নেহপূর্ণ বাতাস পাই, আমি আমার ফুলের মধ্যে করিয়া সেই আলোক সেই বাতাস ফিরাইয়া দিই। জগতের প্রেম আমার মধ্যে ফুল হইয়া ফুটিয়া জগতে ফিরিয়া যায়। আমার যত আছে তত দিই।

 

আরও থাকিলে আরও দিতাম।

 

                        দিয়া কী হয়? শুকাইয়া যায় ছড়াইয়া যায়-- কিন্তু ফুরাইয়া যায় না, আমার কোল তো শূন্য হয় না, প্রতিদিন আবার আমার প্রাণ ভরিয়া উঠে। প্রতিদিন নূতন প্রাণের উচ্ছ্বাস হৃদয় হইতে বাহির করিয়া সূর্যালোকে ফুটাইয়া তুলা, এবং প্রতিদিন আনন্দধারা অজস্রধারে জগতের মধ্যে বিসর্জন করিয়া দেওয়া এই সুখই আমি কেবল জানি; তার পরে আমার ফুল কে চায় আমার ফুল কে গ্রহণ করে, আমার ফুল ফোটানো পুল বিসর্জন অবশ্য কিছু-না-কিছু কাজে লাগেই। আমার ঝরা ফুলগুলি জগৎ কুড়াইয়া লয়। অতীত আমার ঝরা ফুল লইয়া মালা গাঁথে। আমার সহস্র ফুল অবিশ্রাম ঝরিয়া ঝরিয়া সুদূর ভবিষ্যতের জন্য এক অপূর্ব নূতন শতদল রচনা করে। প্রভাতসংগীতের তালে তালে আমার ফুলের পতন হয়। সেই সুমধুর ছন্দে আমার ফুলের পতনে জগতের নৃত্যগীত সম্পূর্ণ হইতেছে।

 

                        আকাশের তারাগুলিও স্বর্গীয় কল্পতরু ঝরা ফুল, তাহারা কি কোনো কাজে লাগে না? মালার মতো গাঁথিয়া কেহ কি তাহাদের গলায় পরে নাই? কোমল বলিয়া আমার ফুলগুলির উপরে কেহ কি পাও রাখিবে না? আমি জানি আমার ফুলগুলি ঝরিয়া জননী লক্ষ্মীর পদ্মাসনের তলে পুনর্জন্ম স্তরের উপর স্তরে জগৎব্যাপী স্তরের মধ্যে একটি ছোটো পাপড়ি হইয়া আনন্দে বিকশিত হইতে থাকে।

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •