পারিবারিক স্মৃতিলিপি পুস্তক, ২|১০|৮৯


 

সাহিত্য (sahityo)


যেটুকু সাহিত্যের মর্ম, তাহা সংজ্ঞার মধ্যে ধরা দেয় না। তাহা প্রাণপদার্থের মতো।-- কী কী না থাকিলে তাহা টেঁকে না তাহা জানি, কিন্তু সে যে কী তাহা জানি না। জীবন হইতেই জীবন সংক্রামিত হয়, অগ্নি হইতেই অগ্নি জ্বলাইতে হয়-- তেমনি লেখকের অন্তরাত্মা হইতে কলমের মুখে যখন প্রাণ ক্ষরিয়া পড়ে তখনই জীবন্ত সাহিত্যের জন্ম হয়। সাহিত্য সম্বন্ধে "জীবন" "প্রাণ" প্রভৃতি কথাগুলো হয়তো mystic। কিন্তু পরিষ্কার কথা বলিবার কোনো উপায় নাই। সাহিত্যের মধ্যে একটা জীবন আছে, এবং সে জীবন লেখকের মানবজীবনের নিগূঢ় কেন্দ্র হইতে চুঁইয়া পড়ে, ভাষার মধ্যে স্থায়ী হয় ও ভাষাকে স্থায়ী করিয়া তুলে-- এই কথাগুলো নিজের আন্তরিক অভিজ্ঞতার সাহায্যে একপ্রকার আন্দাজে বুঝিয়া লইতে হইবে।

 

তাঁহার নাটকের পাত্রগুলিকে আপনার প্রাণের মধ্য হইতে জন্ম দিয়াছেন-- বুদ্ধি হইতেই নয়, ধর্মনীতি হইতেও নয়, এমন-কি feelings হইতে নয়-- সমস্ত মানববৃত্তির দ্বারা বেষ্টিত জীবনকোষের মধ্য হইতে। সাহিত্যের মধ্যে সৃজনের ভাব আছে, নির্মাণের ভাব নাই। সৃজনের মধ্যে একটা রহস্যময় প্রাণময় আত্মবিস্মৃত নিয়ম আছে, নির্মাণ আপনা হইতেই তাহার হাতধরা। সৃজনশক্তি এক হিসাবে নির্মাণশক্তি অপেক্ষা অচেতন, আবার আর-এক হিসাবে তাহা অপেক্ষা সচেতন। কারণ, নির্মাণকালে প্রতিমুহূর্তে সচেতন আত্মকর্তৃত্ব জড় উপাদানের প্রতি প্রয়োগ করিতে হয়। সৃজনে তাহা নয়। কিন্তু সৃজনকালে সেই জড় উপাদানের মধ্যে যেন এক অপূর্ব নিয়মে চেতনা সঞ্চার করিয়া দেওয়া হয়, সে যেন আপনাকে আপনি গড়িয়া তুলে। যেন নিজের নাড়ির সহিত তাহার যোগ সাধন করিয়া দেওয়া হয় এবং সহজেই তাহার মধ্যে জীবন প্রবাহিত হয়। বাষ্পীয় কলে দেখা যায় এক ঘূর্ণ্যমান চাকার সহিত আর-এক চাকার যোগ করিয়া বিভিন্ন দিকে গতি সঞ্চার করা [হয়]। তেমনি এই বৃহৎ সংসারচক্রের আবর্তনের সঙ্গে আমার জীবনচক্র ঘুরিতেছে, তাহারি কে[ন্দ্রের] মধ্য দিয়া সংসারের গতির সহিত সাহিত্যের যোগ সাধন করা হয়, এই উপায়ে সাহিত্য বৃহৎ জীবনের অনন্তগতি প্রাপ্ত হয়। কেহ-বা হাতে করিয়া ঠেলিতেছে,কেহ-বা ঘোড়া জুড়িয়া ছুটাইতেছে, কেহ-বা জীবনের চক্রের সহিত বাঁধিয়া দিতে পারিয়াছে, শেষোক্ত উপায়েই সাহিত্য স্থায়ী গতি প্রাপ্ত হয়।

 

কিন্তু এই-সকল তুলনা উপমাকে কল্পনার খেলা বলিয়া মনে হয়, পাকা কথা বলিয়া বোধ হয় না। পাকা কথা মানে, যে কথা সকলেই যাচাই করিয়া লইতে পারে। পূর্বেই একরকম বলা গিয়াছে এ-সকল কথা তেমন সন্তোষজনকরূপে পাকা করিয়া লওয়া অসম্ভব।

 

আমি নিজে বার বার দেখিয়াছি, এবং এ কথা বোধ হয় কাহাকেও নূতন বলিয়া বোধ হইবে না, যে, যখন সাহিত্যরচনার মধ্যে মগ্ন থাকা যায় তখন যেন এক প্রকার অতিচেতন অবস্থা প্রাপ্ত হইতে হয়। যেন আর-একজন অন্তঃপুরুষ আমার অধিকাংশ চেতনা অপহরণ করিয়া আমার অর্ধেক অজ্ঞাতসারে কাজ করিয়া যায়। সে যেন আমার সমস্ত সঞ্চিত জ্ঞাত ও অজ্ঞাত অভিজ্ঞতাকে আমার Real এবং Ideal-কে প্রতিদিনের আমাকে এবং আমার সম্ভাবিত আমাকে গলাইয়া লেখার মধ্যে তাহারই এক বিন্দু ঢালিয়া দেয়। আমার জীবনের যাহা সারবিন্দু তাহা সমস্ত মানবজীবনের ধন, তাহা কেবলমাত্র আমার একটা অজ্ঞেয় অপরিচিত অসম্পূর্ণ অংশ নহে। সুতরাং সেই জীবনশক্তি সাহিত্যের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হইয়া চিরদিন সমস্ত মানবের হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ লাভ করিতে পারে।

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •