শান্তিনিকেতন, ৫ জুলাই, ১৯৩৬


 

দুর্বোধ (durbodh)


অধ্যাপকমশায় বোঝাতে গেলেন নাটকটার অর্থ,

      সেটা হয়ে উঠল বোধের অতীত।

          আমার সেই নাটকের কথা বলি।--

      বইটার নাম "পত্রলেখা',

               নায়ক তার কুশলসেন।

          নবনীর কাছে বিদায় নিয়ে সে গেল বিলেতে।

               চার বছর পরে ফিরে এসে হবে বিয়ে।

                    নবনী কাঁদল উপুড় হয়ে বিছানায়,

          তার মনে হল, এ যেন চার বছরের মৃতুদণ্ড।

নবনীকে কুশলের প্রয়োজন ছিল না ভালোবাসার পথে,

   প্রয়োজন ছিল সুগম করতে বিলাত-যাত্রার পথ।

           সে কথা জানত নবনী,

সে পণ করেছিল হৃদয় জয় করবে প্রাণপণ সাধনায়।

          কুশল মাঝে মাঝে

রুচিতে বুদ্ধিতে উঁচট খেয়ে ওকে হঠাৎ বলেছে রূঢ় কথা,

            ও সয়েছে চুপ করে;

      মেনে নিয়েছে নিজেকে অযোগ্য বলে,

            ওর নালিশ নিজেরই উপরে।

ভেবেছিল দীনা বলেই একদিন হবে ওর জয়,

    ঘাস যেমন দিনে দিনে নেয় ঘিরে কঠোর পাহাড়কে।

         এ যেন ছিল ওর ভালোবাসার শিল্পরচনা,

নির্দয় পাথরটাকে ভেঙে ভেঙে রূপ আবাহন করা

      ব্যথিত বক্ষের নিরন্তর আঘাতে।

আজ নবনীর সেই দিনরাতের আরাধনার ধন গেল দূরে।

      ওর দুঃখের থালাটি ছিল অশ্রু-ভেজা অর্ঘ্যে ভরা,

আজ থেকে দুঃখ রইবে কিন্তু দুঃখের নৈবেদ্য রইবে না।

এখন ওদের সম্বন্ধের পথ রইল

শুধু এ পারে ও পারে চিঠি লেখার সাঁকো বেয়ে।

কিন্তু নবনী তো সাজিয়ে লিখতে জানে না মনের কথা,

   ও কেবল যত্নের স্বাদ লাগাতে জানে সেবাতে,

         অর্‌কিডের চমক দিয়ে যেতে ফুলদানির 'পরে

                   কুশলের চোখের আড়ালে,

         গোপনে বিছিয়ে আসতে

                 নিজের-হাতে-কাজ-করা আসন

                         যেখানে কুশল পা রাখে।

কুশল ফিরল দেশে,

     বিয়ের দিন করল স্থির।

  আঙটি এনেছে বিলেত থেকে,

              গেল সেটা পরাতে;

  গিয়ে দেখে ঠিকানা না রেখেই নবনী নিরুদ্দেশ।

            তার ডায়ারিতে আছে লেখা,

       "যাকে ভালোবেসেছি সে ছিল অন্য মানুষ,

            চিঠিতে যার প্রকাশ, এ তো সে নয়।"

                 এ দিকে কুশলের বিশ্বাস

                       তার চিঠিগুলি গদ্যে মেঘদূত,

                          বিরহীদের চিরসম্পদ।

                       আজ সে হারিয়েছে প্রিয়াকে,

            কিন্তু মন গেল না চিঠিগুলি হারাতে --

      ওর মমতাজ পালালো, রইল তাজমহল।

নাম লুকিয়ে ছাপালো চিঠি "উদ্‌ভ্রান্তপ্রেমিক' আখ্যা দিয়ে

                 নবনীর চরিত্র নিয়ে

            বিশ্লেষণ ব্যাখ্যা হয়েছে বিস্তর।

কেউ বলেছে, বাঙালির মেয়েকে

              লেখক এগিয়ে নিয়ে চলেছে

      ইবসেনের মুক্তিবাণীর দিকে --

                  কেউ বলেছে রসাতলে।

      অনেকে এসেছে আমার কাছে জিজ্ঞাসা নিয়ে;

            আমি বলেছি, " আমি কী জানি।"

         বলেছি, " শাস্ত্রে বলে, দেবা ন জানন্তি।"

                 পাঠকবন্ধু বলেছে,

        "নারীর প্রসঙ্গে না হয় চুপ করলেম

            হতবুদ্ধি দেবতারই মতো,

                  কিন্তু পুরুষ?

         তারও কি অজ্ঞাতবাস চিররহস্যে।

    ও মানুষটা হঠাৎ পোষ মানলে কোন্‌ মন্ত্রে।"

আমি বলেছি,

"মেয়েই হোক আর পুরুষই হোক; স্পষ্ট নয় কোনো পক্ষই;

     যেটুকু সুখ দেয় বা দুঃখ দেয় স্পষ্ট কেবল সেইটুকুই।

                      প্রশ্ন কোরো না,

                          পড়ে দেখো কী বলছে কুশল।"

    কুশল বলে, "নবনী চার বছর ছিল দৃষ্টির বাইরে,

          যেন নেমে গেল সৃষ্টির বাইরেতেই;

               ওর মাধুর্যটুকুই রইল মনে,

                   আর সব-কিছু হল গৌণ।

    সহজ হয়েছে ওকে সুন্দর ছাঁদে চিঠি লিখতে।

         অভাব হয়েছে, করেছি দাবি --

            ওর ভালোবাসার উপর অবাধ ভরসা

                       মনকে করেছে রসসিক্ত, করেছে গর্বিত।

প্রত্যেক চিঠিতে আপন ভাষায় ভুলিয়েছি আপনারই মন।

            লেখার উত্তাপে ঢালাই করা অলংকার

ওর স্মৃতির মূর্তিটিকে সাজিয়ে তুলেছে দেবীর মতো।

            ও হয়েছে নূতন রচনা।

এই জন্যেই খ্রীষ্টান শাস্ত্রে বলে,

            সৃষ্টির আদিতে ছিল বাণী।"

পাঠকবন্ধু আবার জিগেস করেছে,

   "ও কি সত্যি বললে,

            না, এটা নাটকের নায়কগিরি?"

                 আমি বলেছি, "আমি কী জানি।"

 

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •