যোগাযোগ (jogajog)

প্রথম অঙ্ক

বিপ্রদাস।
কুমু, জানলার কাছে সমস্ত সকাল একলা বসে কী করছিস, বোন? মানিকতলার তেলকলের বাঁশি শুনছিস? আর দেখছিস ওই রাস্তার ধারে জলের কলের কাছে হিন্দুস্থানী মেয়ের সঙ্গে উড়ে বামুনের ঝগড়া!
কুমুদিনী।
দাদা, আমি ভাবছি কলকাতাটা কী ভয়ানক বড়ো, আর আমি তার এক কোণে কতই ছোটো!
বিপ্রদাস।
কলকাতা যে অচেনা, তাই তো এর বড়োর বড়াই রে। ওকে হৃদয় দিয়ে ঘিরে নিতে পারি নি রে বোন, পারি নে। আর আমাদের সেই নুরনগরের পৈতৃক ভিটে, সে এর চেয়ে কত ছোটো কিন্তু কত বড়ো। সেই যে পুব আকাশের দিগন্তে ঘন বন, সেই যে ধানের খেত পেরিয়ে বালুর চর, চর পেরিয়ে নীল জলের রেখা, কাশবন, বন-ঝাউয়ের ঝোপ, গুণ টানার পথ, জেলের নৌকোর খয়েরি রঙের পাল, বাঁশঝাড়ের মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে গোপীনাথজির মন্দির-চুড়ো, সে আমাদের নীল-আকাশ-ভরা শ্যামল নুরনগর, সে কত বড়ো কিন্তু কত আপন।
কুমুদিনী।
কচি ছেলের কাছে মা যত বড়ো সে আমাদের ততই বড়ো, তবুও সে নিতান্ত সহজ আমাদের কাছে, নিতান্ত আপনার।
বিপ্রদাস।
আর এই কলকাতাটা কোন্‌ দৈত্য-ইস্কুলের ক্লাসে ময়লা আকাশের বোর্ডের উপর জিয়োমেট্রির খোঁচা-ওয়ালা আঁক-কাটা প্রব্লেম। কিন্তু ভয় করলে চলবে না কুমু।
কুমুদিনী।
করব না ভয়।
বিপ্রদাস।
এই শক্ত প্রব্লেম নিয়েই পরীক্ষা পাস করতে হবে।
কুমুদিনী।
নিশ্চয় পাস করব তোমার আশীর্বাদে। শক্তকেই জোরের সঙ্গে মেনে নেব। তুমি আমার জন্য ভেবো না দাদা।
বিপ্রদাস।
কী জানিস, আমাদের বাপ-দাদার ছিল সেকেলে নবাবি চাল। আতসবাজির মতো সেদিনকার ঐশ্বর্যের ঝলক তাঁরা শূন্যে মিলিয়ে শেষ করে দিয়ে গেছেন। আমাদের জন্যে রেখে গেলেন পোড়া ঐশ্বর্যের ঋণের অঙ্গার। ওইটে সাফ করে যেতে হবে। ভালোই হয়েছে কুমু, সেকালের বাবুগিরির নোংরা উচ্ছিষ্ট ভোগ করতে আমরা আসি নি। কী বলিস কুমু?
কুমুদিনী।
হাঁ দাদা, ভালোই হয়েছে।
বিপ্রদাস।
আমরা সহ্য করতে জয় করতে এসেছি। ভোগ করতে আসি নি। সেই দেউলে সেকাল, সেই ভূতে পাওয়া হানাবাড়ি, তার চেয়ে অনেক ভালো এই পাষাণী কলকাতার নীরস অনাদর।
কুমুদিনী।
ভালো, ভালো, ঢের ভালো। দাদা, তুমি ভাবছ আমাদের চিরদিনের ভিটে ছেড়ে এসে আমি কষ্ট পাচ্ছি-- তাই মাঝে মাঝে আমাকে সাহস দিতে চাও। কিন্তু কষ্ট পেলেই বা কী। আমার ঠাকুর আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন, তিনি আমাকে ভুলতে দেবেন না বলেই। আমি ঐশ্বর্যের কাঙাল নই। আমি চাই তাঁকেই, আমার প্রাণের ঠাকুরকে। কিন্তু দাদা, আমাকে একটি কথা দিতে হবে।
বিপ্রদাস।
কী বল্‌ কুমু।
কুমুদিনী।
তুমি যখন কোনো দুঃখ পাবে আমার কাছে লুকোতে পারবে না। তোমার দুঃখের ভাগ নেব আমি; ঐশ্বর্যের ভাগ নাই-বা রইল!
বিপ্রদাস।
আচ্ছা, তাই হবে।
কুমুদিনী।
তা হলে এখনি তার প্রমাণ দাও।
বিপ্রদাস।
হাতে হাতে তোর জন্যে দুঃখ বানাতে হবে নাকি?
কুমুদিনী।
না, বানাবার দরকার নেই। আমি জানি আজ তোমাকে ব্যথা লেগেছে। আমার কাছে তুমি লুকোতে পারবে না।
বিপ্রদাস।
আমার ব্যথার হাল খবরটা নাহয় তোর কাছ থেকেই শুনে নিই।
কুমুদিনী।
আজ বিলেতের ডাকে তুমি ছোড়দাদার কাছ থেকে চিঠি পেয়েছ, সেই চিঠিতে তোমাকে কষ্ট দিয়েছে।
বিপ্রদাস।
তুই আমার সুখদুঃখের ব্যারোমিটার হয়ে উঠলি দেখছি।
কুমুদিনী।
না দাদা, কথাটা উড়িয়ে দিয়ো না।
বিপ্রদাস।
তাই তো বটে। প্রতিদিনের যত কাঁটা খোঁচা সবই তোর জন্যে জমিয়ে রাখতে হবে? এমন ভীষণ দাদাগিরি নাই-বা করলেম।
কুমুদিনী।
আমাকে তুমি ছেলেমানুষ বলেই ঠিক করেছ। সত্যিই ছিলুম ছেলেমানুষ, নুরনগরে যতদিন পূর্বপুরুষের জীর্ণ ঐশ্বর্যের আওতায় ছিলুম। তার ভিত ভাঙতেই আজ একদিনেই যেন আমার বয়স বেড়ে গেছে। আজ আমাকে স্নেহের আড়ালে ভুলিয়ে রেখো না, আজ তোমার দুঃখের অংশ আমাকে দাও, তাতেই আমার ভালো হবে। বলো, ছোড়দাদা কী লিখেছেন।
বিপ্রদাস।
সুবোধ টাকা চেয়ে পাঠিয়েছে, অত টাকা দেবার শক্তি আমার নেই।
কুমুদিনী।
দাদা, একটা কথা বলি, রাগ করবে না বলো।
বিপ্রদাস।
রাগ করবার মতো কথা হলে, রাগ না করতে পারলে যে দম ফেটে মরব।
কুমুদিনী।
না দাদা, ঠাট্টা নয়। শোনো আমার কথা। মায়ের গয়না তো আমার জন্যে আছে, তাই নিয়ে--
বিপ্রদাস।
চুপ, চুপ, তোর গয়নাতে কি আমরা হাত দিতে পারি?
কুমুদিনী।
আমি তো পারি।
বিপ্রদাস।
না, এখন তুইও পারিস নে। থাক্‌ সে-সব কথা। যা, তোর সংস্কৃত পড়া তৈরি করতে যা, অনেকদিন পড়া কামাই গেছে।
কুমুদিনী।
না দাদা, "না' বোলো না, আমার কথা রাখতেই হবে।
বিপ্রদাস।
মতের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবি তুই? তোর শাসনে "না'কে "হাঁ' করতে হবে?
কুমুদিনী।
আমার গয়না সার্থক হোক, দিক তোমার ভাবনা ঘুচিয়ে।
বিপ্রদাস।
সাধে তোকে বলি বুড়ি! তোর গয়না নিয়ে আমার ভাবনা ঘোচাব আমি, এমন কথা ভাবতে পারলি কোন্‌ বুদ্ধিতে? ওই-যে দেওয়ানজি আসছেন।
কুমুদিনী।
আমি তা হলে যাই।
বিপ্রদাস।
না, যাবি কেন? এখন থেকে সব কথা তোর সামনেই হবে।
দেওয়ানজির প্রবেশ
বিপ্রদাস।
ভূষণ রায় করিমহাটি তালুক পত্তনি নিতে চেয়েছিল,না? কত পণ দেবে?
দেওয়ানজি।
বিশ হাজার পর্যন্ত উঠতে পারে।
বিপ্রদাস।
একবার ভূষণ রায়কে তলব দিয়ে পাঠাও। কথাবার্তা কইতে চাই।
দেওয়ানজি।
বিশেষ কি তাড়া আছে?
বিপ্রদাস।
তুমি তো জান সুবোধ টাকা চেয়ে পাঠিয়েছে।
দেওয়ানজি।
তিনি তো ছেলেমানুষ নন, বুঝবেন না কি টাকা না থাকলে টাকা দেওয়া যায় না?
বিপ্রদাস।
সুবোধ দূরে গিয়ে পড়েছে। দরদ দিয়ে বোঝবার এলেকা সে পেরিয়ে গেছে, বোঝাতে চেষ্টা করলে দ্বিগুণ অবুঝ হয়ে উঠবে-- ভালো ফল হবে না।
দেওয়ানজি।
বড়োবাবু, একটা কথা ভেবে দেখবার সময় হয়েছে। মধুসূদন ঘোষাল হঠাৎ গায়ে পড়ে আমাদের চাটুজ্জেগুষ্টির সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে এল, আমাদের সব দেনা এক ক'রে এগারো লাখ টাকা কম সুদে তোমাকে ধার দিলে, একদিন হঠাৎ তার অপঘাত এসে পড়বে আমাদের ঘাড়ের উপর, তার জন্যে তো সময় থাকতে প্রস্তুত হতে হবে।
বিপ্রদাস।
অপঘাতের জন্যে দশ-বিশটা ডাণ্ডা ওঁচানো ছিল দশ-বিশ জন মহাজনের হাতে। তার জায়গায় একখানা মোটা ডাণ্ডা এসে ঠেকেছে কেবল ওই ঘোষালের হাতে। আগেকার চেয়ে এতে কি বেশি ভাবনার কারণ ঘটেছে?
দেওয়ানজি।
তবে শোনো, সে তোমার জন্মের আগেকার কথা, স্বর্গীয় কর্তাবাবুর দপ্তরে তখন আমি মুনশিগিরিতে সবে ভর্তি হয়েছি। সেই সময়ে চাটুজ্জে আর ঘোষাল বংশে ভীষণ কাজিয়া বেধে গেল কার্তিক মাসে বিসর্জনের মিছিল নিয়ে। দু-পাঁচটা খুনোখুনি হয়ে গেল। তারই মকর্দমায় ঘোষালরা উচ্ছন্ন হয়ে বেরিয়ে পড়ল পথে। সেই বংশের ছেলে মধুসূদন একদিন রজবপুরে পাটের আড়তে আট টাকা মাইনের মুহুরিগিরিতে ঢুকে আজ ক্রোড়পতি হয়ে উঠেছে, সে হঠাৎ তোমার সঙ্গে আত্মীয়তা করতে আসে কেন?
বিপ্রদাস।
সে তো বহু পুরোনো ইতিহাসের কথা।
দেওয়ানজি।
বড়োবাবু, তোমার সরল মন, এই সহজ কথাটা বুঝতে পারছ না-- তোমরা মেরেছিলে, ওরা মার খেয়েছিল। তোমাদের ইতিহাস ফিকে হয়ে এসেছে, কিন্তু ওদের ইতিহাস রক্তের অক্ষরে লেখা।
বিপ্রদাস।
তা হতে পারে, কিন্তু কী পরামর্শ দাও শুনি।
দেওয়ানজি।
তুমি যে ছোটোবাবুর খেয়ালে আজ তালুক বিকিয়ে দিতে বসেছ সেটা ভালো কথা নয়-- সমস্তই হাতে রাখতে হবে শেষ মারটা ঠেকাবার জন্যে। চুপ করে রইলে যে। কথাটা মনে নিচ্ছে না। তোমরা হচ্ছ রাজার বংশের ছেলে, আমরা মন্ত্রীর বংশের। বরাবর দেখে আসছি-- যে ডালে দাঁড়াও সেই ডালে তোমরা কোপ মার, আর আমরা তলায় দাঁড়িয়ে বৃথা দোহাই পাড়ি। তোমাদেরই সর্বনেশে জেদ বজায় থাকে। শেষকালে ধুপ করে ঘারে এসে পড়ে ওই হতভাগা মন্ত্রীর ছেলেরই।
বিপ্রদাস।
সুবোধ যখন এমন কথা লিখতে পেরেছে যে সম্পত্তিতে তার অর্ধেক অংশ বেচে তাকে টাকা পাঠাতে হবে, তখন এর চেয়ে বড়ো আঘাতের কথা আমি ভাবতে পারি নে। আমার সম্পত্তি আর তার সম্পত্তিতে আজ তার ভেদবুদ্ধি ঘটল! এক দেহকে দু ভাগ করবার কথা আজ সে ভাবতে পারলে! এ নিয়ে আর কোনো কথা বলতে চাই নে-- আমি চললুম। এখনো আমার সকালবেলার অনেক কাজ বাকি আছে।
[ উভয়ের প্রস্থান ]
কুমুদিনী।
কাকাবাবু, ছোড়দাদা এমন চিঠি কী করে লিখতে পারলেন?
দেওয়ানজি।
সে কথা ভেবে লাভ কী মা! দুঃখ যার সহ্য করবার মহত্ত্ব আছে, ভগবান তারই ধৈর্যের কঠিন পরীক্ষা করেন। তোমার দাদা দুঃখ পাবেন জানি, কিন্তু হারবেন না সেও জানি।
কুমুদিনী।
কাকাবাবু, মায়ের দেওয়া আমার গয়না তোমারই তো জিম্মেয় আছে। সেইগুলো বেচে তুমি দাদাকে ভাবনা থেকে বাঁচাও-না।
দেওয়ানজি।
সর্বনাশ! তাঁর মনকে ঠাণ্ডা করবার চেষ্টায় তাকে কি আরো আগুন করে তুলতে হবে? শান্তিরক্ষা করার সহজ উপায় এ নয় মা।
কুমুদিনী।
মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলে সংকটের দিনে কি কিছুই করতে পারি নে, কেবল কেঁদেই মরতে পারি?
দেওয়ানজি।
সে কী কথা! দুঃখের দিনে তোমার দাদাকে তুমি যে সান্ত্বনা দিচ্ছ গয়না দেওয়ার সঙ্গে তার কি তুলনা হয় মা? চোখ জুড়িয়ে আজ তুমি যে তাঁর সামনে আছ এই তো পরম সৌভাগ্য। বিধাতা আমাদের সর্বস্ব নিতে পারেন, কিন্তু তোমার দাদার সব চেয়ে বড়ো সম্পদ যে তিনি তোমারই হৃদয়ের মধ্যে লুকিয়ে রেখে দিয়েছেন, সে কথা তুমি বুঝবে কী করে।
কুমুদিনী।
এ কথা কাউকে বলি নি, আজ তোমাকেই বলছি, কাকাবাবু, জানি নে কেন কেবলই আমার মন বলছে আমারই আপন ভাগ্যে আমিই আমার দাদাকে রক্ষা করব-- সেইজন্যেই এই সর্বনাশের দিনে আমি জন্মেছি। নইলে আমার কী দরকার ছিল এই সংসারে।
দেওয়ানজি।
তোমার মুখখানি দেখলেই বুঝতে পারি মা, লক্ষ্ণী আমাদের ঘরে বিদায় নেবার সময় তোমাকেই তাঁর প্রতিনিধি রেখে দিয়ে গেছেন। সব অভাব দূর হবে।
কুমুদিনী।
পরশুদিন যখন দাদার মুখ বড়ো শুকনো দেখেছিলুম, আমি থাকতে পারলুম না, ঠাকুরঘরে গিয়ে ঠাকুরকে বললুম-- আমাদের দুঃখের দিন শেষ হল এই কথাটি বলো তুমি, প্রসন্ন যদি হয়ে থাক তবে তোমার পায়ে যেন আজ অপরাজিতার একটি ফুল দিয়ে প্রণাম করতে পারি। থালা থেকে চোখ বুজে নানা ফুলের মধ্যে যেই একটি ফুল তুলে নিলেম-- দেখি সেটি অপরাজিতা। সেই দিন থেকে আমার বাঁ চোখ নাচছে। ইচ্ছে হল ছুটে গিয়ে দাদাকে এই সুখবরটা দিই। কিন্তু দাদা যে এ-সব কিছুই মানেন না, তাই বলতে পারলুম না। কাকাবাবু, তুমিও কি ঠাকুর মান না?
দেওয়ানজি।
সে কী কথা মা! যে ঠাকুর তুমি আর তোমার দাদার মতো মানুষ গড়েছেন তাঁকে মানব না এত অসাড় কি আমার মন?
কুমুদিনী।
দাদা শুনলে হেসে বলবেন এ সমস্তই রূপকথা-- কিন্তু কাল রাত্রে অরুন্ধতী তারার দিকে চেয়ে যখন বসে ছিলেম, আমি যেন বুকের মধ্যে শুনতে পেলেম দূরের রথের শব্দ-- অন্ধকারের ভিতর দিয়ে রাজা আসছেন, আমাকে গ্রহণ করবেন, সব দুঃখ দূর করবেন। কাকাবাবু, দুটি পায়ে পড়ি আমার কথা তুমি বিশ্বাস করো।
দেওয়ানজি।
খুব বিশ্বাস করি। আমি যে কিনু আচার্যির কাছে বর্ষফল গণনা করাতে গিয়েছিলেম, তিনি কুষ্ঠি দেখে বললেন তুমি রাজরানী হবে, আর দেরী নেই। তবে যাই মা-- আমার কাজ আছে।
[ উভয়ের প্রস্থান ]
কুমুদিনী।
বনমালী। ও বনমালী!
বনমালী ভৃত্যের প্রবেশ
ভৃত্য।
কী দিদিমণি!
কুমুদিনী।
ওই-যে ভিখারি যাচ্ছে। একটু থামতে বল্‌-- আমার একখানা কাপড় নিয়ে আসি, ওকে দিতে হবে। আমার হাতে আজ কিছু নেই।
বনমালী।
আমার কাছে আছে, আমি কিছু দিয়ে দিচ্ছি, কাপড়খানি কেন নষ্ট করবে?
কুমুদিনী।
তুই দিলে আমার তাতে কী? তুই জানিস নে ওই ভিক্ষুকের কাছেও আমি ভিক্ষুক-- ওর আশীর্বাদে আমার দরকার আছে!
[ উভয়ের প্রস্থান ]
বিপ্রদাসের প্রবেশ
বিপ্রদাস।
বনমালী!
বনমালী।
আজ্ঞে!
বিপ্রদাস।
খবর পাঠিয়েছে কে এসেছে আমার সঙ্গে দেখা করতে, ডেকে দে তো।
বনমালীর প্রস্থান ও ঘটককে নিয়ে পুনঃপ্রবেশ
ঘটক।
নমস্কার।
বিপ্রদাস।
কে তুমি?
ঘটক।
আজ্ঞে, কর্তারা আমাকে খুবই চিনতেন-- আপনারা তখন শিশু। আমার নাম নীলমণি ঘটক, গঙ্গামণি ঘটকের পুত্র।
বিপ্রদাস।
কী প্রয়োজন?
ঘটক।
পাত্রের খবর নিয়ে এসেছি, আপনাদেরই ঘরের উপযুক্ত।
বিপ্রদাস।
কে বলো তো?
ঘটক।
বিশেষ করে পরিচয় দেবার দরকার হবে না-- স্বনামধন্য লোক।
বিপ্রদাস।
শুনি কী নাম?
ঘটক।
রাজাবাহাদুর মধুসূদন ঘোষাল।
বিপ্রদাস।
মধুসূদন!
ঘটক।
ওই-যে আলিপুরে লাটসাহেবের বাগানবাড়ির এক পাড়াতেই মস্ত তিনতলা বাড়ি যাঁর।
বিপ্রদাস।
তাঁর ছেলে আছে নাকি?
ঘটক।
আজ্ঞে না, তিনি অবিবাহিত। আমি তাঁর কথাই বলছি।
বিপ্রদাস।
তাঁর সঙ্গে বয়সের মিল আছে এমন মেয়ে আমাদের ঘরে নেই।
ঘটক।
পুরুষ মানুষের বয়েস, ওটা তুচ্ছ কথা। ঐশ্বর্যে বয়েস চাপা পড়ে যায়। এ কথা জোর করেই বলব এমন পাত্র সমস্ত শহরে আর একটিও মিলবে না।
বিপ্রদাস।
কিন্তু পাত্রী তো মিলবে না আমার ঘরে।
ঘটক।
ভেবে দেখবেন, আমাদের রাজাবাহাদুর এবার বছর না পেরোতেই মহারাজা হবেন, এটা একেবারে লাটসাহেবের নিজ মুখের কথা, পাকা খবর।
বিপ্রদাস।
তুমি তাঁদের ওখান থেকে কথা নিয়ে এসেছ নাকি?
ঘটক।
তাঁর মতো লোকের তো ভাবনা নেই, ভাবনা আমাদেরই। এ শুধু আমার ব্যাবসার কথা নয়, এ আমার কর্তব্য-- সৎপাত্রের জন্যে উপযুক্ত পাত্রী জুটিয়ে দেওয়া একটা মস্ত শুভকর্ম।
বিপ্রদাস।
কর্তব্যের কথাটা আরো অনেক আগে চিন্তা করলেই ভালো করতে। এখন সময় পেরিয়ে গেছে।
ঘটক।
সময় আমাদের হাতে নেই, আছে গ্রহদের হাতে। তাঁদেরই চক্রান্তে এতদিন পরে রাজাবাহাদুরের মাথায় ভাবনা এসেছে যে, যখন মহারাজ পদবির সাড়া পাওয়া গেল তখন মহারানীর পদটা আর তো খালি রাখা চলবে না। আপনাদের গ্রহাচার্য বেচারাম ভট্‌চাজ দূর সম্পর্কে আমার সম্বন্ধী, তার কাছে কন্যার কুষ্ঠী দেখা গেল। লক্ষণ ঠিকটি মিলেছে। দেখে নেবেন, আমি বলেই দিচ্ছি, এ সম্বন্ধ হয়েই গেছে, এ প্রজাপতির নির্বন্ধ, কেউ খণ্ডাতে পারবে না।
বিপ্রদাস।
বৃথা সময় নষ্ট করছ। প্রজাপতির কাজ প্রজাপতিই সেরে নেবেন-- আমি এর মধ্যে নেই।
ঘটক।
আচ্ছা, তাড়া নেই, ভালো করে ভেবে দেখুন। আমি আসছে শুক্রবার এসে আর-একবার খবর নিয়ে যাব।
[ উভয়ের প্রস্থান ]
দেওয়ানজির প্রবেশ
বিপ্রদাস।
একজন ঘটক এসেছিল।
দেওয়ানজি।
এখানে আসবার আগে আমার সঙ্গে দেখা করেছে।
বিপ্রদাস।
আমি ওকে বিদায় করে দিয়েছি।
দেওয়ানজি।
প্রস্তাবটা শুনেই আমার বুকটা লাফিয়ে উঠেছিল। ভাবলুম হঠাৎ বুঝি কূল পাওয়া গেল। কিন্তু বড়ো বেশি লোভ যখন হয় তখনি বড়ো বেশি ভুল করবার আশঙ্কা। তাই চুপ করে গেলুম, ভাবলুম, বড়োবাবু শুনে কী বলেন দেখা যাক।
বিপ্রদাস।
নিজেদের উদ্ধার করবার লোভে কুমুকে ভাসিয়ে দিই যদি তা হলে কি আর বেঁচে সুখ থাকবে?
দেওয়ানজি।
ওর মধ্যে ভয়ের কথা আছে। ঘটককে ফিরিয়ে দিলে পাত্রের সেটা কি সইবে? ওর হাতে যে আমাদের মারের অস্ত্র।
বিপ্রদাস।
নিজের অন্তরের মারই সব চেয়ে বড়ো মার, সেই লোভের মারকেই সব দিয়ে ঠেকাতে হবে।
দেওয়ানজি।
কথাটা নিছক লোভের কথা নয় তাও বলি। ওই মানুষটি একটা জাল তো জড়িয়েছে, সে ঋণের জাল, তার উপরে সম্বন্ধের ফাঁস যদি আঁট করে লাগায় তা হলে অন্তরে বাইরে প্রাণ নিয়ে টান পড়বে। এটা ওর কিস্তিমাতের শেষ চাল কি না সেও তো ভেবে পাচ্ছি নে।
কুমুর প্রবেশ
কুমুদিনী।
দাদা, কেন তোমরা আমার জন্যে মিছে ভাবছ?
বিপ্রদাস।
কী ভাবছি?
কুমুদিনী।
আমি এই ঘরেই আসছিলুম-- এমন সময়ে ঘরের বাইরে চটিজুতো আর ছাতা দেখে থেমে গেলুম। বারান্দা থেকে সব কথা আমি শুনিছি।
বিপ্রদাস।
ভালোই হয়েছে। তা হলে জেনেছ আমি ঘটকের কথায় কান দিই নি।
কুমুদিনী।
আমি কান দিয়েছি দাদা।
বিপ্রদাস।
ভালোই তো। কান দেবার আর মত দেবার মতো বয়স তোর এল। এ প্রস্তাবে তোর কথাই শেষ কথা। বাবা যখন ছিলেন, তোর বয়স দশ, বিয়ে প্রায় ঠিক হয়েই গিয়েছিল। হয়ে গেলে তোর মতের অপেক্ষা থাকত না। আজ তো তা আর সম্ভব নয়। রাজা মধুসূদন ঘোষালের কথা আগেই নিশ্চয় শুনেছিস। বংশমর্যাদায় খাটো নন। কিন্তু বয়সে তোর সঙ্গে অনেক তফাত। আমি তো রাজি হতে পারলেম না। এখন তোরই মুখের একটা কথা পেলেই চুকিয়ে দিতে পারি। লজ্জা করিস নে কুমু।
কুমুদিনী।
না, লজ্জা করব না। ইতস্তত করবারও সময় নেই। যাঁর কথা বলছ নিশ্চয়ই তাঁর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ স্থির হয়েই গেছে।
বিপ্রদাস।
কেমন করে স্থির হল?
কুমু নীরব
বিপ্রদাস।
ছেলেমানুষি করিস নে।
কুমুদিনী।
তুমি বুঝবে না দাদা, একটুও ছেলেমানুষি করছি নে।
বিপ্রদাস।
তুই তো তাঁকে দেখিস নি।
কুমুদিনী।
তা হোক। আমি যে ঠিক জেনেছি।
বিপ্রদাস।
দেখ্‌ কুমু, চিরজীবনের কথা, ফস্‌ করে খেয়ালের মাথায় পণ করে বসিস নে।
কুমুদিনী।
না দাদা, খেয়াল নয়। এই আমি তোমার পা ছুঁয়ে বলছি, আমি আর কাউকেই বিয়ে করব না।
বিপ্রদাস।
আমি তোর কথা কিছুই বুঝতে পারছি নে।
কুমুদিনী।
তুমি বুঝতে পারবে না দাদা। আমার যাঁর সঙ্গে বোঝাপড়া হয়ে গেছে তিনি আমার অন্তর্যামী।
দেওয়ানজি।
বড়োবাবু, উনি যাঁর কথা শুনতে পান আমরা তাঁর কাছে কালা। এতে আমাদের হাত দেওয়া ভালো হবে না। আমি মনে বিশ্বাস রাখি ওঁর ঠাকুর ওঁকে ফাঁকি দেবেন না।
বিপ্রদাস।
কিছুদিন সবুর করে দেখবি নে কুমু? যদি তোর ভুল হয়ে থাকে?
কুমুদিনী।
না দাদা, হয় নি ভুল।
বিপ্রদাস।
তা হলে আমি কথা পাঠিয়ে দিই?
কুমুদিনী।
হাঁ, পাঠিয়ে দাও।
  •  
  •