মণিপুরের বর্ণনা (manipurer bornona)


নাইটিন্থ সেঞ্চুরি

 

সার জেমস্‌ জন্‌স্টন্‌ জুন মাসের নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি পত্রিকায় মণিপুরের যে বর্ণনা প্রকাশ করিয়াছেন তাহা পাঠ করিয়া সহসা মনের মধ্যে একটি বিষাদের ভাব উদয় হয়।

 

স্থানটি রমণীয়। চারি দিকে পর্বত, মাঝখানে একটি উপত্যকা; বাহিরের পৃথিবীর সহিত কোনো সম্পর্ক নাই। ভূমি অত্যন্ত উর্বরা, মানুষগুলি সরল এবং উদ্‌যোগী, রাজকর নাই বলিলেই হয়, রাজাকে কেবল বরাদ্দমতো পরিশ্রম দিতে হয়। যে শস্য উৎপন্ন হয় আপনারাই সংবৎসর খায় এবং সঞ্চয় করে, বাহিরে পাঠায় না, বাহির হইতেও আমদানি করে না। অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে এখানকার দৃশ্যটি বড়ো মনোহর হইয়া উঠে। দিন উজ্জ্বল, আকাশ পরিষ্কার, বাতাস শীতল, পাকাধানে শস্যক্ষেত্র সোনার বর্ণ ধারণ করিয়াছে। মেয়েরা শোভন বস্ত্র পরিয়া দলে দলে ধান কাটিতেছে, বলিষ্ঠ পুরুষেরা শস্যের আঁটি বহন করিয়া ঘরে লইয়া যাইতেছে। নিকটে গোরুগুলি ধীর গতিতে প্রদক্ষিণ করিয়া ধান মাড়াই করিতেছে, শস্যবিচ্ছিন্ন তৃণ এক পার্শ্বে রাশীকৃত হইতেছে, ধান যখন ঘরে আসিবে তখন সেই তৃণে আনন্দোৎসবের অগ্নি প্রজ্বলিত হইবে।

 

রাজধানীতে সন্ধ্যাবেলায় হাট বসে, সেইটেই দিবসের মধ্যে প্রধান ঘটনা। যতই বেলা পড়িয়া আসিতে থাকে পথ হাট লোকে পরিপূর্ণ হইয়া যায়। পুরুষদের নির্মল শুভ্র বসন এবং মেয়েদের নানাবিধ উজ্জ্বল বর্ণের বিচিত্র সজ্জা। মেয়েরাই বিক্রেতা। দেখিতে পাওয়া যায় মাথায় পণ্য দ্রব্য এবং কোলে অথবা পিঠে কচি ছেলে লইয়া তাহারা "সেনা কাইথেল' অর্থাৎ সোনাবাজারে হাট করিতে আইসে, পথ উজ্জ্বল হইয়া উঠে।

 

বাজারের কাছে পোলো খেলিবার মাঠ। শহরের ভালো ভালো খেলোয়াড় এমন-কি রাজপুত্রগণ সেইখানে প্রায় প্রত্যহ খেলা করে; সেখানে কুস্তিও চলে এবং রাজসৈন্যদের কুচও হইয়া থাকে।

 

রাজবাড়ির চারি দিকে খাল কাটা আছে সেইখানে আশ্বিন মাসে একবার করিয়া নৌকা বাচ হয়। সেই উপলক্ষে মহা সমাগম হয়। রাজা, রাজকুটুম্ব, রানী এবং রাজকন্যাগণ নিদিষ্ট মঞ্চে বসিয়া বাচ খেলা দেখেন; মেয়েদের কোনোরূপ পর্দা নাই, অবগুণ্ঠন নাই।

 

ইহা ছাড়া জন্মাষ্টমী, দেওয়ালি, হোলি, রথযাত্রা প্রভৃতি আরও অনেক উৎসব আছে। আষাঢ় মাসে এক ব্যায়াম-উৎসব হইয়া থাকে তখন চারি দিক হইতে সমাগত পাহাড়িয়াদিগের সহিত মণিপুরীদের কুস্তি প্রভৃতি নানাবিধ ব্যায়ামনৈপুণ্যের পরীক্ষা হয়।

 

এই প্রচ্ছন্ন পর্বতপুরীতে ঐশ্বর্য-আড়ম্বরের কোনো চিহ্ন দেখা যায় না, কিন্তু এখানে সরল সুখসন্তোষের লেশমাত্র অভাব নাই। রাজা যথেচ্ছাচারী, কিন্তু প্রজাদিগের মনে স্বজাতীয় রাজগৌরব সর্বদা জাগরূক। তাহারা বহুকাল হইতে আপনাদের রাজা এবং রাজকীয় বিবিধ অনুষ্ঠান, আপনাদের সোনার হাট, নৌকাখেলা, উৎসব আমোদ লইয়া শৈলকুলায়ের মধ্যে সুখে বাস করিতেছে। এই জগতের একান্তবর্তী সন্তোষকলকূজিত নিভৃত নীড়ের মধ্যে সভ্যতার নির্মম হস্তক্ষেপ দেখিলে এই কথা মনে পড়ে,

 

গড়ন ভাঙিতে, সখি, আছে নানা খল,

ভাঙিয়া গড়িতে পারে সে বড়ো বিরল।

 

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •