ভারতী, ভাদ্র, ১২৯০


 

জিজ্ঞাসা ও উত্তর (jigyasa o uttor)


আমাদের কাছে এক প্রশ্ন আসিয়াছে, জাতীয়তার লক্ষণ কী? কী কী গুণ থাকিলে কতকগুলি লোক একজাতীয় বলিয়া গণ্য হয়। এক দেশে যাহারা থাকে তাহারাই কি এক জাতীয়? কিন্তু তাহা হইলে যে আর-একটা কথা ওঠে। এক দেশ কাহাকে বলে? যে পরিমিত ভূমির অধিকাংশ অধিবাসী এক জাতীয় তাহাই তো এক দেশ। অতএব, গোড়ায় জাতি নির্দেশ না হইলে দেশ নির্দেশ হইবে কী করিয়া? তাহা ছাড়া পূর্বোক্ত সংজ্ঞা অনুসারে মুসলমানেরাও আমাদের সহিত এক জাতীয় হইয়া পড়ে। তবে কি ধর্মের ঐক্যে জাতির ঐক্য স্থির হয়? তাহাই বা কী করিয়া বলিব? কারণ তাহা হইলে খৃস্টান হইলেই আমি ইংরাজ হইয়া যাই। তাহা হইলে ফরাসি ও জর্মানেরাও ধর্মের ঐক্যে ইংরাজদের সহিত একজাতি বলিয়া গণ্য হয়। যদি বল যাহারা এক রাজতন্ত্রের অন্তর্ভূত তাহারা এক জাতি, তবে তাহার বিরুদ্ধেও বক্তব্য আছে; কারণ তাহা হইলে ব্রিটিশ ব্রহ্মদেশীয়েরাও আমাদের সহিত এক জাতি। কেহ কেহ বলিবেন যাহাদের পরস্পরের মধ্যে সামাজিক আচার-ব্যবহারের ঐক্য আছে, তাহারা এক জাতীয় বলিয়া গণ্য হয়। কিন্তু সে কথা ঠিক নহে, কারণ আমাদের দেশীয় মহারাষ্ট্রী, বাঙালি, পঞ্জাবি প্রভৃতিদের সামাজিক আচার-ব্যবহারের বিস্তর অনৈক্য আছে; তাহা ছাড়া অনেক বিভিন্ন য়ুরোপীয় জাতির আচার-ব্যবহারের অনেক ঐক্য আছে। কেহ কেহ বলিবেন, যাহাদের পূর্বপুরুষগণ এক সূত্রে বদ্ধ ছিল, ও সেই অবধি পুরুষানুক্রমে একত্রে বাস করিয়া আসিতেছে তাহাদের এক জাতি বলা যায়। কিন্তু এ নিয়ম তো সর্বত্র খাটে না। একজন হিন্দু কয়েক বৎসর ইংলন্ডে বাস করিয়া অনুষ্ঠানবিশেষ আচরণ করিলে ইংরাজ হইয়া যাইতে পারেন। কিন্তু হিন্দুর পূর্বপুরুষ ইংরাজের পূর্বপুরুষের সহিত ঐতিহাসিক কালের মধ্যে কখনো একসূত্রে বদ্ধ ছিলেন না। অতএব স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, ইংরাজেরা Nation বলিতে যাহা বুঝেন, আমরা জাতি বলিতে তাহা বুঝি না। জাতি শব্দ Nation অপেক্ষা অনেক বিস্তৃত এবং Nation অপেক্ষা অনেক সংকীর্ণ অর্থে প্রয়োগ হয়। আমরা মনুষ্য সাধারণকে মনুষ্যজাতি বলি, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদিগকে হিন্দুজাতি বলি, আবার তাহারও উপবিভাগকে জাতি বলি, যথা, বাঙালি জাতি, আবার সামাজিক সংকীর্ণ শ্রেণী-বিভাগকেও জাতি শব্দে অভিহিত করিয়া থাকি, যথা ব্রাহ্মণ জাতি, কায়স্থ জাতি ইত্যাদি। জাতি শব্দের ধাতুগত অর্থ দেখিতে গেলে দেখা যায়, জন্মের সাদৃশ্য বুঝাইতেই জাতি শব্দের উৎপত্তি হইয়াছে। কিন্তু স্পষ্টই দেখা যাইতেছে ক্রমশ ইহার অর্থান্তর ঘটিয়াছে।

 

প্রশ্নকর্তা হয়তো জিজ্ঞাসা করিবেন, আমরা হিন্দুজাতি বলিলে যাহা বুঝি, সে জাতিত্ব কিসে স্থির হয়? তাহার উত্তর, ধর্মে। কতকগুলি ধর্ম হিন্দুধর্ম বলিয়া স্থির হইয়া গিয়াছে। হিন্দুধর্ম নামক এক মূল ধর্মের নানা শাখা-প্রশাখা চারি দিকে বিস্তারিত হইয়াছে, (তাহা হইতে আরও অনেক শাখা-প্রশাখা এখনও বাহির হইতে পারে) এই-সকল ধর্ম উপধর্ম যাহারা আশ্রয় করিয়া থাকে তাহারা হিন্দু। কিন্তু যখনি কোনো হিন্দু এই-সকল শাখা-প্রশাখা পরিত্যাগ করিয়া একেবারে সর্বতোভাবে ভিন্ন ধর্মবৃক্ষ আশ্রয় করেন তখনি তিনি আর হিন্দু থাকেন না। মুসলমান জাতিদিগেরও এইরূপ। ইংরাজ ফরাসি প্রভৃতি য়ুরোপীয়দিগের এরূপ নহে। রাজ্যতন্ত্রের ঐক্যেই তাহাদের জাতিত্ব নির্ধারিত হয়। একজন ইংরাজ ও একজন মার্কিনবাসীর হয়তো আর কোনো প্রভেদ নাই, উভয়ের এক পূর্বপুরুষ, এক ভাষা, এক ধর্ম, এক আচার-ব্যবহার পরিচ্ছদ, তথাপি উভয়ে এক Nation-ভুক্ত নহেন, কারণ উভয়ের রাজ্য-তন্ত্রগত প্রভেদ আছে।

 

অতএব দেখা গেল, হিন্দু জাতির ধর্মই মুখ্য লক্ষণ, আহার ব্যবহার পরিচ্ছদ ভাষা প্রভৃতি গৌণ। ইংরাজ জাতির রাজ্যতন্ত্রই মুখ্য লক্ষণ, ধর্ম প্রভৃতি অবশিষ্ট আর-সকল গৌণ।

 

এইখানে একটি কথা উত্থাপন করা যাইতে পারে। "জাতীয়' নামক একটি শব্দ আমাদের ভাষায় নূতন সৃষ্ট হইয়াছে। "দেশীয়' শব্দটি কানে যেমন দেশী বোধ হয়, "জাতীয়' শব্দটি সেরূপ হয় না। অনবরত ব্যবহার করিয়া এ শব্দটি যাঁহাদের অভ্যাস হইয়া গিয়াছে, তাঁহাদের কথা বলিতে পারি না, কিন্তু "জাতীয় পত্রিকা' বা "জাতীয় নাট্যশালা' বলিতে কানে কেমন খারাপ শুনায়, কেবল তাহাই নয়, একজন সরল দিশি লোক ও শব্দটির অর্থ ঠিক বুঝিতেই পারিবে না; কারণ জাতি শব্দে আমাদের ভাষায় বৃহৎ হইতে ক্ষুদ্র এত অর্থ বুঝায়, যে বিশেষণ যোগ করিয়া না দিলে উহার ঠিক অর্থ নির্দিষ্ট হয় না। হিন্দুজাতীয় পত্রিকা বা হিন্দুজাতীয় নাট্যশালা বলিলে শুনিবামাত্রই অর্থবোধ হয়। তাহাতে এই বুঝায়, ধর্ম ও অন্যান্য ঐক্য থাকাতে যে জাতি হিন্দু নামে উক্ত হইয়াছেন, এই পত্রিকা ও এই নাট্যশালা তাঁহাদেরই কর্তৃক ও তাঁহাদেরই সম্বন্ধীয়। জাতীয় পত্রিকা ও জাতীয় নাট্যশালার পরিবর্তে দেশীয় পত্রিকা ও দেশীয় নাট্যশালা শব্দ ব্যবহার করো, তাহা হইলেই দেখিতে পাইবে কোন্‌ শব্দটা সাধারণ লোকে শুনিবামাত্রই বুঝিতে পারে।

 

নামক শব্দ "জাতীয় তহবিল' "জাতীয় ধনভাণ্ডার' ইত্যাদি নানারূপে অনুবাদিত হইতেছে। কিন্তু ইহাতে কি অর্থের ব্যাঘাত হইতেছে না? যখন মুসলমানদিগের নিকট হইতেও উক্ত ভাণ্ডারের জন্য টাকা লওয়া হইতেছে, তখন উক্ত ভাণ্ডারকে জাতীয় কীরূপে বলা যায়? ইচ্ছা করিলে কে কী না বলিতে পারে কিন্তু ইহা আমাদের ভাষার বিরোধী। তাহার চেয়ে "দেশীয় তহবিল' বা "দেশীয় ধনভাণ্ডার' বলা হউক-না কেন? একেবারে অবিকল ইংরাজির তর্জমা করিবার আবশ্যক কী? ইংরাজি Nation শব্দের স্থলে আমাদের দেশ শব্দ ঠিক খাটে না বটে, কিন্তু ইংরাজেরা যেখানেই National শব্দ ব্যবহার করেন, সেইখানেই সহজ বাংলায় "দেশীয়' শব্দ প্রয়োগ হয়। National Institution-কে "দেশীয় অনুষ্ঠান' বলিলেই তবে ঠিক National হয়, নতুবা উহা প্রায় ইংরাজিই থাকিয়া যায়।

 

এইখানে একটি প্রশ্ন উঠে। প্রাচীন হিন্দুগণ নিজের নামকরণ করেন নাই। তাঁহারা অন্যান্য জাতির নাম দিয়াছিলেন, যথা শক, যবন, কিরাত রোমক ইত্যাদি, কিন্তু নিজের নাম নিজে দিবার আবশ্যক বিবেচনা করেন নাই। কেবল সাধারণত আর সকলের সহিত প্রভেদ জানাইবার সময় আপনাদিগকে আর্য ও আর সকলকে অনার্য বলিতেন। কিন্তু আর্য শব্দ একটি বিশেষণ শব্দ মাত্র, উহা জাতির বিশেষ নামবাচক শব্দ নহে। অতএব, Nation অর্থে জাতি শব্দের ব্যবহার সংস্কৃত সাহিত্যে কখন হইতে আরম্ভ হইয়াছে? যবন রোমক প্রভৃতিকে শুদ্ধমাত্র যবন রোমক বলা হইত, না যবন জাতি, রোমক জাতি বলা হইত? সংক্ষেপে, Nation অর্থে জাতি শব্দের ব্যবহার প্রাচীন সংস্কৃতে আছে কি না? যদি না থাকে তো কখন হইতে আরম্ভ হইয়াছে কেহ বলিতে পারেন কি না? আর জাতি শব্দ ঠিক কী কী অর্থে সংস্কৃতে ব্যবহার হইত, তাহার প্রয়োগ সমেত কেহ অনুগ্রহপূর্বক দেখাইয়া দিবেন কি? ব্রাহ্মণ শূদ্র প্রভৃতি সামাজিক শ্রেণীবিভাগকে প্রাচীন ভাষায় "বর্ণ' বলা হইত, কোথাও কি জাতি বলা হইয়াছে? মাগধ, কৈকেয়, প্রভৃতি ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশবাসীকে কি প্রাচীন সংস্কৃতে বিভিন্ন জাতি বলা হইয়াছে? এক কথায় জাতি শব্দে প্রাচীন সংস্কৃতে ঠিক কী কী অর্থ বুঝাইত, এবং কী কী বুঝাইত না, সে বিষয়ে আমরা শিক্ষা লাভ করিতে চাহি।

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •