ভারতী, শ্রাবণ, ১২৮৫


 

স্যাক্‌সন জাতি ও অ্যাংলো স্যাক্‌সন সাহিত্য (saxon jati)


এই প্রবন্ধে স্যাক্‌সন জাতির আচার ও ব্যবহার, ভাষা ও সাহিত্য বিস্তৃতরূপে বর্ণনা করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। যে ভিত্তির উপর আধুনিক ইংরাজি মহা-সাহিত্য স্থাপিত আছে সেই অ্যাংলো স্যাক্‌সন ভাষা ও সাহিত্য পরীক্ষা করিয়া দেখিতে এবং যে ভিত্তির উপর সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বরস্বরূপ ইংরাজ জাতি আদৌ স্থাপিত, সেই স্যাক্‌সনদের রীতিনীতি সমালোচনা করিয়া দেখিতে আজ আমরা প্রবৃত্ত হইলাম। কিডমন, বিউল্গ্‌মাস, টেন প্রভৃতির সার সংগ্রহ করিয়া আজ আমরা পাঠকদিগকে উপহার দিতেছি।

 

রোমানেরা ব্রিটনে রাজ্য স্থাপন করিলে পর এক দল শেল্‌ট (celt) তাহাদের বশ্যতা স্বীকার না করিয়া ওয়েল্‌স ও হাইল্যান্ডের পার্বত্য প্রদেশে আশ্রয় লইল। যাহারা রোমকদের অধীন হইল তাহাদের মধ্যে রোমক সভ্যতা ক্রমে ক্রমে বিস্তৃত হইতে লাগিল। রোমকদের অধিকৃত দেশে প্রশস্ত রাজপথ নির্মিত হইল, দৃঢ় প্রাচীরে নগরসমূহ বেষ্টিত হইল-- বাণিজ্য ও কৃষির যথেষ্ট উন্নতি হইল-- নর্দাম্বর্লন্ডের লৌহ, সমার্সেটের শীষক, কর্নওয়ালের টিন-খনি আবিষ্কৃত হইল। কিন্তু বাহিরে সভ্যতার চাকচিক্য যেমন বাড়িতে লাগিল, ভিতরে ভিতরে ব্রিটনের শোণিত ক্ষয় হইয়া আসিতে লাগিল। রোমকেরা তাহাদের সকল বিষয়ের স্বাধীনতা অপহরণ করিল-- তাহাদিগকে বিদ্যা শিখাইল-- উন্নততর ধর্মে দীক্ষিত করিল-- সভ্যতা ও অসভ্যতার প্রভেদ দেখাইয়া দিল-- কিন্তু কী করিয়া স্বদেশ শাসন করিতে হয় তাহা শিখাইল না। সুশাসনে থাকাতে জেতৃজাতির উপর তাহারা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করিল-- কখনো যে বিপদে পড়িতে হইবে সে কথা ভুলিয়া গেল, সুতরাং আত্মরক্ষণের ভাব অন্তর্হিত ও পরপ্রত্যাশার ভাব তাহাদের চরিত্রে বদ্ধমূল হইল। এইরূপ অস্বাস্থ্যকর সভ্যতা সে জাতির সর্বনাশ করিল। রোমকদের কর-ভারে নিপীড়িত হইয়াও তাহাদের একটি কথা বলিবার জো ছিল না। এক দল জমিদারের দল উত্থিত হইল-- ও সেইসঙ্গে কৃষক দলের অধঃপতন হইল-- কৃষকেরা জমিদারদের দাস হইয়া কাল যাপন করিতে লাগিল। এইরূপে রোমকদিগের অধিকৃত ব্রিটনেরা ভিতরে ভিতরে অসার হইয়া আসিল। রোমক-পুঁথি পড়িতে ও রোমক-ভাষায় কথা কহিতে শিখিয়াই তাহারা মনে করিল ভারি সভ্য হইয়া উঠিয়াছি ও স্বাধীন শেল্‌ট ও পিক্টদিগকে অসভ্য বলিয়া মনে মনে মহা ঘৃণা করিতে লাগিল। প্রায় চারি শতাব্দী ইহাদের এইরূপ মোহময় সুখ-নিদ্রায় নিদ্রিত রাখিয়া সহসা একদিন রোমকেরা তাহাদিগকে পরিত্যাগ করিল। গথেরা ইটালি আক্রমণ করিয়াছে, সুতরাং রোমকেরা নিজদেশ রক্ষা করিতে ব্রিটন ছাড়িয়া স্বদেশে চলিয়া গেল, আর ফিরিল না। অসভ্যতর শেল্‌ট, পিক্ট, স্কট প্রভৃতি সামুদ্রিক দস্যুগণ চারি দিক হইতে ঝাঁকিয়া পড়িল-- তখন সেই অসহায় সভ্য জাতিগণ কাঁপিতে কাঁপিতে জর্মনি হইতে অর্থ দিয়া সৈন্য ভাড়া করিয়া আনিল। হেঞ্জেস্ট ও হর্সা তাহাদের সাহায্য করিতে সৈন্য লইয়া এবস্‌ফ্লিটে জাহাজ হইতে অবতীর্ণ হইল।

 

ইহারাই অ্যাঙ্গল্‌স্‌ (Angles)। ব্রিটনেরা এবং রোমকেরা ইহাদিগকে স্যাক্‌সন বলিত। ইহাদের ভাষার নাম Seo Englisce Spraec অর্থাৎ English Speech। হলান্ড হইতে ডেনমার্ক পর্যন্ত ওই যে সমুদ্র-সীমা দেখিতেছ, মেঘময়, কুজ্‌ঝটিকাচ্ছন্ন আর্দ্রভূমি বিস্তৃত রহিয়াছে--  বহু শতাব্দী পূর্বে উহা নিবিড় অরণ্যে আবৃত ছিল, সেই আরণ্য ভূভাগ অ্যাঙ্গল্‌স্‌দের বাসস্থান ছিল। এমন কদর্য স্থান আর নাই। বৃষ্টি ঝটিকা মেঘে সেই দেশের মস্তকের উপর কী যেন অভিশাপের অন্ধকার বিস্তার করিয়া রাখিয়াছে। দিবারাত্রি উন্মত্ত জলধি তীরভূমি আক্রমণ করিতেছে-- এই ক্ষুভিত সমুদ্রের মুখে কোনো জাহাজের সহজে নিস্তার নাই। এই সমুদ্রতীরে, তুষার কুজ্‌ঝটিকাচ্ছন্ন-ঝঞ্ঝাঝটিকা-ক্ষুব্ধ অন্ধকার অরণ্যে ও জলায় শোণিত-পিপাসু সামুদ্রিক দস্যুদল বাস করিত। এই মনুষ্যশিকারীরা জীবনকে তৃণ জ্ঞান করিত। সেই সময়কার রোমক কবি কহিয়াছেন, "তাহারা আমাদের শত্রু; সমুদয়  শত্রু অপেক্ষা হিংস্র, এবং যেমন হিংস্র তেমনি ধূর্ত। সমুদ্র তাহাদের যুদ্ধ-শিক্ষালয়, ঝটিকা তাহাদের বন্ধু; এই সমুদ্র-ব্যাঘ্রেরা পৃথিবী লুণ্ঠন করিবার জন্যই আছে।' তাহারা আপনারাই গাহিত, "ঝটিকা-বেগ আমাদের দাঁড়ের সহায়তা করে-- আকাশের নিশ্বাসস্বরূপ বজ্রের গর্জন আমাদের হানি করিতে পারে না-- ঝঞ্ঝা আমাদের ভৃত্য-- আমরা যেখানে যাইতে ইচ্ছা করি সে আমাদের সেইখানেই বহন করিয়া লইয়া যায়।' স্ত্রীলোক এবং দাসদের উপর ভূমি কর্ষণ ও পশুপালনের ভার দিয়া ইহারা সমুদ্র ভ্রমণ, যুদ্ধ ও দেশলুণ্ঠন করিতে যাইত। রক্তপাত করাই তাহারা মুক্ত স্বাধীন জাতির কার্য বলিয়া জানিত-- স্বাধীনতা ও মুক্ত ভাবের ইহাই তাহাদের আদর্শ ছিল। নরহত্যা ও রক্তপাত তাহাদের ব্যবসায়, ব্যবসায় কেন, তাই তাহাদের আমোদ ছিল। Ragnar Lodbrog নামক গাথক গাহিতেছে-- "অসি দিয়া আমরা তাহাদিগকে কাটিয়া ফেলিলাম;-- আমার সুন্দরী পত্নীকে যখন প্রথম আমার পার্শ্বে শয্যায় বসাইলাম তখন আমার যেরূপ আমোদ হইয়াছিল, সেই সময়েও কি আমার তেমনি আমোদ হয় নাই?' যখন এজিল (Egil) ডেনমার্কবাসী জার্লের কন্যার পার্শ্বে উপবেশন করিল, তখন সেই কন্যা তাঁহাকে "তিনি কখনো নেকড়িয়া বাঘদিগকে গরম গরম মনুষ্য মাংস খাইতে দেন নাই ও সমস্ত শরৎকালের মধ্যে মৃতদেহের উপর কাক উড়িতে দেখেন নাই' বলিয়া ভর্ৎসনা করিয়া দূরে ঠেলিয়া দিল। তখন এজিল এই বলিয়া তাহাকে শান্ত করে "আমি রক্তাক্ত অসি হস্তে যুদ্ধযাত্রা করিয়াছি, নর-দেহ-লোলুপ কাকেরা আমার অনুসরণ করিয়াছে। দারুণ যুদ্ধ করিয়াছি এবং মনুষ্য আলয়ের উপর দিয়া অগ্নি চলিয়া গিয়াছে। যাহারা দ্বার রক্ষা করিতে নিযুক্ত ছিল, তাহাদিগকে রক্তের উপর ঘুম পাড়াইয়াছি।' তখনকার কুমারীদের সহিত এইরূপ কথোপকথন চলিত। ইহাদের গ্রামবাসীদের সম্বন্ধে ট্যাসিটস্‌ বলেন যে ইহারা সকলেই পৃথক পৃথক আপনার আপনার লইয়াই থাকে। এমন বিজনতা ও স্বাতন্ত্র্যপ্রিয় জাতি আর নাই। প্রত্যেক গ্রামবাসী যেমন আপনার ভূমিটুকু লইয়া স্বতন্ত্র থাকে তেমনি আবার প্রত্যেক গ্রাম অন্য গ্রামের সহিত স্বতন্ত্র থাকিতে চায়। প্রত্যেক গ্রাম চারি ধারে অরণ্য বা পোড়োভূমির দ্বারা ঘেরা থাকে-- সে ভূমি কোনো বিশেষ ব্যক্তির অধিকারভুক্ত নহে-- সেইখানে দোষী ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড হইত-- এবং সেইখানে সকল-প্রকার উপদেবতার আবাস বলিয়া লোকের বিশ্বাস ছিল। যখন কোনো নূতন ব্যক্তি সেই অরণ্য বা পোড়োভূমির মধ্যে আসিত তখন তাহাকে শৃঙ্গা বাজাইয়া আসিতে হইত। নিঃশব্দে আসিলে শত্রুজ্ঞান করিয়া যার ইচ্ছা সেই বধ করিতে পারিত। ইহাদের সকলেরই প্রায় একটু একটু ভূমি থাকিত, এবং যাহাদের এইরূপ ভূমি থাকিত তাহাদের নাম কার্ল (churl) (মনুষ্য) ছিল। তাহাদিগকে Freenecked man (মুক্তস্কন্ধ মনুষ্য) কহিত-- অর্থাৎ তাহাদের কোনো প্রভুর নিকট স্কন্ধ নত করিতে হইত না। তাহাদের আর-এক নাম ছিল "শস্ত্রধারী' অর্থাৎ তাহাদেরই অস্ত্রবহন করিবার অধিকার ছিল। প্রথমে ইহাদের মধ্যে বিচারপ্রণালী ছিল না-- প্রত্যেক মনুষ্য আপনার আপনার প্রতিহিংসা সাধন করিত। ক্রমে ন্যায় ও বিচার প্রচলিত হইল। তখনকার অপরিস্ফুটদণ্ডনীতি বলেন-- চোখের বদলে চোখ, প্রাণের বদলে প্রাণ দাও, কিংবা তার উপযুক্ত মূল্য দাও। যাহার যে অঙ্গ তুমি নষ্ট করিবে, তোমার নিজের সেই অঙ্গ দান করিতে হইবে, কিংবা তাহার উপযুক্ত মূল্য দিতে হইবে। এ মূল্য যে দোষী ব্যক্তিই দিবে তাহা নহে, দোষী ব্যক্তির পরিবার আহত ব্যক্তির পরিবারকে দিবে। প্রত্যেক কুটুম্ব তাঁহার অন্য কুটুম্বের রক্ষক, একজনের জন্য সকলে দায়ী, ও একজনের উপর আর কেহ অন্যায়াচরণ করিলে সকলে তাহার প্রতিবিধান করিবেন। ইহাদের মধ্যে বিশেষ পুরোহিত কেহ ছিল না-- প্রত্যেক ব্যক্তি আপনার আপনার পুরোহিত।

 

নিপীড়িত ব্রিটিশ জাতীয়েরা এই অ্যাঙ্গল্‌স্‌ সৈন্যদিগকে অর্থ দিয়া ভাড়া করিয়া আনিল। কিন্তু দেখিতে দেখিতে ঝাঁকে ঝাঁকে অ্যাঙ্গল্‌স্‌রা ব্রিটনে আসিয়া পড়িল। ব্রিটিশদিগের এত টাকা ও খাদ্য দিবার সামর্থ্য ছিল না, সুতরাং অবশেষে তাহাদেরই সহিত যুদ্ধ বাধিয়া গেল। দারুণ হত্যাকাণ্ড আরম্ভ হইল-- ধনীগণ সমুদ্রপাড়ে পলায়ন করিল। দরিদ্র অধিবাসীরা পার্বত্য প্রদেশে লুকাইয়া রহিল, কিন্তু আহারাভাবে সেখানে অধিক দিন থাকিতে না পারিয়া বাহির হইয়া পড়িত, অমনি নিষ্ঠুর স্যাক্‌সনদের তরবারি-ধারে নিপতিত হইত। দরিদ্র কৃষকেরা গির্জায় গিয়া আশ্রয় লইত-- কিন্তু গির্জার উপরেই স্যাক্‌সনদের সর্বাপেক্ষা অধিক ক্রোধ ছিল। গির্জায় আগুন ধরাইয়া দিয়া আচার্যদিগকে বধ করিয়া একাকার করিত, কৃষক বেচারীরা আগুন হইতে পলাইয়া আসিয়া স্যাক্‌সনদের তরবারিতে নিহত হইত। ফ্র্যাঙ্ক জাতিরা গল্‌ অধিকার করিলে ও লম্বর্ডিগণ ইটালি অধিকার করিলে জেতারাই সভ্যতর জিত জাতিদের মধ্যে লোপ পাইয়া যায়, কিন্তু ইংলন্ডে ঠিক তাহার বিপরীত হয়-- স্যাক্‌সনেরা একেবারে ব্রিটন জাতিকে ধ্বংস করিয়া ফেলে। দুই শতাব্দী ক্রমাগত যুদ্ধ ও ক্রমাগত হত্যা করিয়া স্যাক্‌সনেরা ব্রিটনের আদিম অধিবাসীদের বিলোপ করিয়া দেয়। তখন ইংলন্ড তাহাদেরই দেশ হইল। অল্পস্বল্প দুই-একটি ব্রিটন যাহারা অবশিষ্ট ছিল তাহারা কেহ কেহ স্যাক্‌সন প্রভুর দাস হইয়া রহিল, কেহ কেহ বা ওয়েলস্‌ ও হাইলন্ডের দুর্গম প্রদেশে পলাইয়া গেল। এখনো শেল্‌টিক ভাষা-প্রসূত একপ্রকার ভাষা ওয়েল্‌সে চলিত আছে। ইংরাজি ভাষায় শেল্‌টিক উপাদান খুব অল্পই পাইবে। নবম হইতে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত কেবল কেল্‌টিক বা শেল্‌টিক কথা ইংরাজি ভাষায় প্রচলিত ছিল।

 

রোমকেরা যখন ইংলন্ড বিজয় করিয়াছিলেন তখন অধিকৃত জাতিদিগের রাজভাষা লাটিন ছিল। কিন্তু অ্যাংলো স্যাক্‌সন ভাষায় তখনো লাটিনের কোনো চিহ্ন পড়ে নাই। ইংলন্ডের কতকগুলি দেশের নাম কেবল রোমীয় ধাতু হইতে উৎপন্ন হয়। তাহা ব্যতীত দু-একটি অন্য কথাও রোমীয় ধাতু হইতে প্রসূত হইয়াছিল, যেমন Cheese পনির কথা লাটিন Casens হইতে উৎপন্ন। স্যাক্‌সন munt (পর্বত) কথা বোধ হয় লাটিন mons হইতে গৃহীত হইয়াছে। পর্বত হইতে নৈসর্গিক পদার্থের নামও যে অন্য ভাষা হইতে গৃহীত হইবে, ইহা কতকটা অসম্ভব বলিয়া মনে হইতে পারে, কিন্তু জর্মান সমুদ্রের তীরে বা তাহার নিকটে একটিও পর্বত নাই, সুতরাং সে দেশবাসীরা যে পর্বতের নাম না জানিবে তাহাতে আশ্চর্য নাই।

 

জর্মান জাতিরা যখন স্পেন গল্‌ ও ইতালি জয় করিয়াছিল তখনো সে দেশের ধর্ম, সামাজিক আচার-ব্যবহার ও শাসনপ্রণালীর পরিবর্তন হয় নাই। কিন্তু জর্মান জাতিরা ব্রিটন দ্বীপ যেরূপ সম্পূর্ণরূপে আয়ত্ত করিতে পারিয়াছিল এমন আর কোনো দেশ পারে নাই। রোমীয় সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের উপর সম্পূর্ণরূপে জর্মান সমাজ নির্মিত হইল। ব্রিটিশ আচার-ব্যবহার, ইতালির সভ্যতা, সমস্ত ধ্বংস হইয়া গেল, এবং এই সমতলীকৃত ভূমির উপর আর-একপ্রকার নূতনতর ও উন্নততর সভ্যতার বীজ রোপিত হইল।

 

যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে স্যাক্‌সনদের রাজার প্রয়োজন হইল। পূর্বে তাহাদের রাজা ছিল না। যখন কোথাও যুদ্ধ করিতে যাইত তখন একজনকে প্রধান বলিয়া লইয়া যাইত মাত্র। কিন্তু একটা দেশ অধিকার করিয়া রাখিতে হইলে ও ক্রমাগত তদ্দেশবাসীদের সহিত যুদ্ধবিগ্রহ বাধিলে রাজা নহিলে চলে না। হেঞ্জেস্টের উত্তরাধিকারীরা কেল্‌টের রাজা হইল। এই-সকল যুদ্ধে স্যাক্‌সন জাতিদের মধ্যে দাস-সংখ্যা বাড়িয়া উঠিল। যুদ্ধে বন্দী হইলে উচ্চ শ্রেণীস্থদিগকে দাস হইতে হইত, এবং মৃত্যুমুখ হইতে রক্ষা পাইবার জন্যও দাসত্ব অনেকে আহ্লাদের সহিত গ্রহণ করিত। ঋণ শুধিতে না পারিয়া অনেককে উত্তমর্ণের দাস হইতে বাধ্য হইতে হইত। বিচারে অপরাধী ব্যক্তির পরিবারেরা জরিমানা দিতে না পারিলে সে দোষী ব্যক্তিকে দাসত্ব ভোগ করিতে হইত। এইরূপে স্যাক্‌সনদের মধ্যে একটা দাসজাতি উত্থিত হইল। দাসের পুত্র দাস হইত ইহা হইতেই এই ইংরাজি প্রবাদ উৎপন্ন হয় যে, আমার গোরুর বাছুর আমারই সম্পত্তি। দাস পলাইয়া গেলে পর ধরিতে পারিলে তাহাকে চাবুক মারিয়া খুন করিত বা স্ত্রীলোক হইলে তাহাকে দগ্ধ করিয়া মারিত। যখন ব্রিটনদের সহিত যুদ্ধ কতকটা ক্ষান্ত হইল, তখন তাহাদের আপনাদের মধ্যে যুদ্ধ বাধিল। নর্দাম্বরলন্ডের রাজা ইয়ল্‌ফ্রিথ্‌ অন্যান্য অনেক ইংলিশ রাজ্য জয় করিলেন। কেবল কেন্টের রাজা ইথ্‌ল্‌বার্ট তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। ইয়ল্‌ফ্রিথের অকস্মাৎ মৃত্যুতে এই দুই রাজ্যের মধ্যে তেমন বিবাদ বাধিতে পারে নাই। এই সময়ে খৃস্টান ধর্ম ধীরে ধীরে ইংলন্ডে প্রবেশ করিল। প্যারিসের খৃস্টান রাজকন্যা বাক্‌টার সহিত ইথ্‌ল্‌বার্টের বিবাহ হইল। রাজ্ঞীর সহিত একজন খৃস্টান পুরোহিত কেন্টের রাজধানীতে আসিল। এই বিবাহ-বার্তা শ্রবণে সাহস পাইয়া পোপ গ্রেগরি সেন্ট অগস্টিনকে ইংলন্ডে খৃস্টান ধর্ম প্রচার করিতে পাঠাইয়া দিলেন। কেন্টের অধিপতি তাহাদের ধর্মোপদেশ শ্রবণ করিলেন ও কহিলেন "তোমাদের কথাগুলি বেশ, কিন্তু নূতন ও সন্দেহজনক।' তিনি নিজে স্বধর্ম পরিত্যাগ করিতে চাহিলেন না, কিন্তু খৃস্টানদিগকে আশ্রয় দিতে স্বীকার করিলেন। প্রচলিত ধর্মের সহিত অনেক যুঝাযুঝির পর খৃস্টান ধর্ম ইংলন্ডে স্থান পাইল।

 

ইংলন্ড-বিজেতাদের যে সকলেরই এক ভাষা ও এক জাতি ছিল তাহা নহে। এই খৃস্টান ধর্ম প্রবেশ করিয়া তাহাদের ভাষা ও জাতি অনেকটা এক করিয়া দিল। এই ভাষার ঐক্য সাহিত্যের অল্প উন্নতির কারণ নহে। খৃস্টধর্ম প্রবেশ করিবার পূর্বে অক্ষরে লিখা প্রচলিত ছিল না। খৃস্টধর্ম প্রবেশ করিলে পর স্যাক্‌সনেরা নব উদ্যমে উদ্দীপ্ত হইল ও তাহাদের হৃদয়ের উৎস উন্মুক্ত হইয়া সংগীত-স্রোতে অ্যাংলো সাক্‌সন সাহিত্য পূর্ণ করিল। খৃস্টধর্ম প্রচার হওয়াতে স্যাক্‌সনদের মধ্যে রোমীয় সাহিত্য চর্চার আরম্ভ হইল ও বাইবেলের কবিতার উচ্চ আদর্শ স্যাক্‌সনেরা প্রাপ্ত হইল। যুদ্ধোন্মাদে মত্ত থাকিয়া যে জাতি বিদ্যার দিকে মনোযোগ করিতে পারে নাই, খৃস্টীয় ধর্মের সহিত শান্তি ও ঐক্যে অভিষিক্ত হইয়া সম্মুখে যে ইতালীয় বিদ্যার খনি পাইল তাহাতেই তাহারা মনের সমুদয় উদ্যম নিয়োগ করিল। খৃস্টধর্ম প্রচারের সহায়তা করিবার জন্য তাহারা অ্যাংলো স্যাক্‌সন ভাষায় বাইবেল ও অন্যান্য লাটিন ধর্মপুস্তক অনুবাদ করিতে লাগিল। ইহাতে যে ভাষার ও সাহিত্যের যথেষ্ট উন্নতি হইবে তাহাতে আশ্চর্য কী? অ্যাংলো স্যাক্‌সন ভাষায় লিখিত অধিক প্রাচীন পুস্তক পাওয়া যায় না। অ্যালফ্রেডের সময়েই প্রকৃত প্রস্তাবে উক্ত ভাষা Book language) অর্থাৎ লিখিত ভাষা হইল। প্রাচীনতর পুস্তক যাহা-কিছু পাওয়া যায়, তাহা খৃস্টান ধর্মপ্রচারের পরে অক্ষরে লিখিত হইয়াছে। প্রাচীনতম অ্যাংলো স্যাক্‌সন কাব্যের মধ্যে Lay of Beowulfপ্রধান। ইহা কোন্‌ সময়ে যে রচিত হইয়াছিল তাহা নিশ্চিত বলা যায় না। অনেকে অনুমান করেন খৃস্টান ধর্ম প্রচলিত হইবার পূর্বে ইহা রচিত হইয়া থাকিবে। ইহা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কবিতা অ্যাংলো স্যাক্‌সন ভাষায় পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু ইহার ধরন, ভাব অন্যান্য অ্যাংলো স্যাক্‌সন কবিতার সহিত এত বিভিন্ন যে, এই গীতি সাধারণ স্যাক্‌সন প্রতিভা হইতে উৎপন্ন বলিয়া মনে হয় না। স্কান্দিনেবীয় পৌরাণিক কবিতার সহিত ইহার অনেক সাদৃশ্য আছে। গল্পটির সারমর্ম এই, ডহাম গ্রেন্ডেল বলিয়া এক রাক্ষস ছিল, সে নিকটস্থ জলার মধ্য হইতে বাহির হইয়া রাত্রে গুপ্তভাবে তথাকার রাজবাটির মধ্যে প্রবেশ করিত ও গৃহস্থিত ঘুমন্ত যোদ্ধাদের বিনষ্ট করিত; কেহ কেহ বলেন এই রাক্ষস জলার অস্বাস্থ্যজনক বাষ্পের রূপক মাত্র। বোউল্‌ফ নৃপতি তথায় গিয়া সেই রাক্ষসকে আহত ও নিহত করেন। তিনি ফেনগ্রীব (Foamy necked) জাহাজে চড়িয়া কিরূপে বিদেশীয় রাজসভায় আইলেন এবং তাঁহার অন্যান্য কীর্তি ইহাতে স্কান্দিনেবীয় সাগার ধরনে লিখিত। বোউল্‌ফ এক মহাবীর পুরুষ। "তিনি উন্মুক্ত অসি দৃঢ় হস্তে ধরিয়া ঘোরতর তরঙ্গে ও শীতলতম ঝঞ্ঝায় সমুদ্র পর্যটন করিয়াছেন, ও তাঁহার চারি দিকে শীতের তীব্রতা সমুদ্রের ঊর্মির সহিত যুদ্ধ করিয়াছেন।' কিন্তু তিনি তাহাদিগের কুঠারবিদ্ধ করিলেন। নয় জন সিন্ধুদৈত্য (NICOR) বিনাশ করিলেন। বৃদ্ধ রাজা হ্রথগার (Hrothgar)-কে গ্রেন্ডেল (Grendel) দৈত্যহস্ত হইতে নিস্তার করিবার জন্য অস্ত্রাদি কিছু না লইয়াই আসিলেন। আপনার শক্তির উপর নির্ভর করিয়া তিনি প্রাসাদে শুইয়া আছেন-- "নিশীথের অন্ধকার উত্থিত হইল, ওই গ্রেন্ডেল আসিতেছে, সকলে দ্বার খুলিয়া ফেলিল'-- একজন ঘুমন্ত যোদ্ধাকে ধরিল, "তাহার অজ্ঞাতসারে তাহাকে ছিঁড়িয়া ফেলিল, তাহাকে দংশন করিল, তাহার শিরা হইতে রক্তপান করিল, ও তাহাকে ক্রমাগত ছিঁড়িয়া ছিঁড়িয়া খাইয়া ফেলিল।' এমন সময়ে বোউল্‌ফ উঠিলেন, দৈত্যকে আক্রমণ করিলেন। "প্রাসাদ কম্পিত হইল... উভয়েই উন্মত্ত। গৃহ ধ্বনিত হইল, আশ্চর্য এই যে, যে মদ্যশালা এই সংগ্রামশ্বাপদদিগকে বহন করিয়া ছিল, সে সুন্দর প্রাসাদ ভাঙিয়া পড়ে নাই। শব্দ উত্থিত হইল, তাহা নূতন প্রকারের। যখন নর্থ ডেনমার্কবাসীরা আপনাদের গৃহভিত্তির মধ্যে থাকিয়া শুনিল যে সেই ঈশ্বর-দ্বেষী আপন ভীষণ পরাজয়-সংগীত গাহিতেছে, আঘাত-যন্ত্রণায় আর্তনাদ করিতেছে, তখন একপ্রকার ভয়ে তাহারা আচ্ছন্ন হইয়া পড়িল। ...সেই ঘৃণ্য হতভাগ্যের মৃত্যু-আঘাত পাইতে এখনো বাকি আছে-- অবশেষে সে স্কন্ধে ভীষণ আঘাত পাইল-- তাহার মাংসপেশীসমূহ বিচ্ছিন্ন হইয়া গেল-- অস্থির সন্ধিমূল বিভিন্ন হইল। সমরে বোউল্‌ফের জয় হইল।' বিচ্ছিন্ন হস্ত-পদ গ্রেন্ডেল হ্রদে গিয়া লুকাইল। "সেই হ্রদের তরঙ্গ তাহার রক্তে ফুটিতে লাগিল। হ্রদের জল তাহার শোণিতের সহিত মিশিয়া উষ্ণ হইয়া উঠিল। রক্ত-বিবর্ণ জলে শোণিতের বুদ্‌বুদ উঠিতে লাগিল।' সেইখানেই তাহার মৃত্যু হইল। কিন্তু গ্রেন্ডেলের মাতা, তাহার পুত্রের মতো যাহার "অতি শীতল সলিলের ভীষণ স্থানে বাস নির্দিষ্ট ছিল' সে একদিন রাত্রে আসিয়া আর-একজন যোদ্ধাকে বিনাশ করিল। বোউল্‌ফ্‌ পুনরায় তাহাকে বধ করিতে চলিলেন। একটি পর্বতের নিকট এক ভীষণ গহ্বর ছিল-- সে গহ্বর নেকড়িয়া ব্যাঘ্রদের আবাস স্থান। পর্বতের অন্ধকারে ভূমির নিম্ন দিয়া এক নদী বহিয়া যাইতেছে। বৃক্ষসমূহ শিকড় দিয়া সেই নদী আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে। রাত্রে সেখানে গেলে দেখা যায় সে স্রোতের উপর আগুন জ্বলিতেছে। সে অরণ্যে কেহ নেকড়িয়া ব্যাঘ্র দ্বারা আক্রান্ত হইলে বরং তীরে দাঁড়াইয়া মরিয়া যাইবে তবুও সে স্রোতে লুকাইতে সাহস পাইবে না। অদ্ভুতাকৃতি পিশাচ (Dragon) ও সর্পসমূহ সেই স্রোতে ভাসিতেছে। বোউল্‌ফ সেই তরঙ্গে ডুব দিলেন; বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করিয়া সেই রাক্ষসীর নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন। সে তাঁহাকে মুষ্টিতে বদ্ধ করিয়া তাহার আবাস স্থানে লইয়া গেল। সেখানে এক বিবর্ণ আলোক জ্বলিতেছিল। সেই আলোকে সম্মুখাসম্মুখি দাঁড়াইয়া বীর সেই পাতালের বাঘিনী মহাশক্তি নাগিনীকে দেখিলেন। অবশেষে তাহাকে বধ করিলেন। তাঁহার মৃত্যু-ঘটনা নিম্নলিখিতরূপে কথিত আছে : পঞ্চাশ বৎসর তিনি রাজত্ব করিলে পর এক ড্র্যাগন (Dragon) আসিয়া "অগ্নি-তরঙ্গে' মনুষ্য ও গৃহ নষ্ট করিতে লাগিল। বোউল্‌ফ এক লৌহ-চর্ম নির্মাণ করিলেন। এবং তাহাই পরিধান করিয়া একাকী যুদ্ধ করিতে গেলেন। "নৃপতির এমন উদ্ধত গর্ব ছিল যে, সেই পক্ষবান রাক্ষসের সহিত যুদ্ধে অধিক সঙ্গী ও সৈন্য লইয়া যাইতে চাহিলেন না।' কিন্তু তথাপি কেমন বিষণ্ণ হইয়া অনিচ্ছার সহিত গেলেন, কেননা এইবার তাঁহার অদৃষ্টে মৃত্যু আাছে। সেই রাক্ষস অগ্নি উদ্‌গার করিতে লাগিল। তাহার শরীরে অস্ত্র বিদ্ধ হইল না। রাজা সেই অগ্নির মধ্যে পতিত হইয়া অতিশয় যন্ত্রণা পাইতে লাগিলেন। উইগ্‌লাফ ব্যতীত তাঁহার অন্য সমস্ত সহচর বনে পলায়ন করিল। উইগ্‌লাফ অগ্নিমধ্যে প্রবেশ করিল, এবং তাহাদের উভয়ের খড়্‌গাঘাতে সেই ড্রাগন বিচ্ছিন্ন-শরীর ও বিনষ্ট হইল। কিন্তু রাজার ক্ষতস্থান ফুলিয়া উঠিল ও জ্বলিতে লাগিল, "তিনি দেখিলেন তাঁহার বক্ষের মধ্যে বিষ ফুটিতেছে।' তিনি মৃত্যুকালে বলিলেন, "পঞ্চাশ বৎসর আমি এই-সকল প্রজাদিগকে পালন করিয়াছি। এমন কোনো রাজা ছিল না যে আমাকে ভয় দেখাইতে বা আমার নিকট সৈন্য পাঠাইতে সাহস করিত। আমার যাহা-কিছু ছিল তাহা ভালোরূপ রক্ষা করিয়াছি, কোনো বিশ্বাসঘাতকতা করি নাই, অন্যান্য শপথ করি নাই। যদিও আমি মৃত্যু-আঘাত প্রাপ্ত হইয়াছি, এই-সকল কারণে তথাপি আমার আনন্দ হইতেছে। প্রিয় উইগ্‌লাফ! এখনি যাও, ওই শ্বেত-প্রস্তর-শালা (দৈত্যের আবাস) অনুসন্ধান করিয়া দেখো, গুপ্তধন পাইবে। আমার জীবন দিয়া ধনরাশি ক্রয় করিয়াছি, উহা আমার প্রজাদের অভাবের সময় কাজে লাগিবে। আমার মৃত্যুর পূর্বে আমার প্রজাদের জন্য এই যে ধন পাইয়াছি ইহার নিমিত্ত দেবতার নিকট ঋণী রহিলাম।' এই কাব্যের কবিতা যতই অসম্পূর্ণ হউক, ইহার নায়ক যে অতি মহান তাহাতে আর সন্দেহ নাই। ইঁহার চরিত্রে প্রতিপদে পৌরুষ প্রকাশ পাইতেছে। পরের উপকারের জন্য নিজের প্রাণ দিতে ইনি কখনো সংকুচিত হন নাই। সেই সময়কার সমাজের অসভ্য অবস্থায় এরূপ চরিত্র যে চিত্রিত হইতে পারিবে ইহা একপ্রকার অসম্ভব বলিয়া বোধ হয়।

 

অ্যাংলো স্যাক্‌সন কবিতা হৃদয়ের কথা মাত্র, আর কিছুই নহে। ইহাতে চিন্তার কোনো সংস্রব নাই। ইহার কবিতা কতকগুলি ভাঙা ভাঙা কথার সমষ্টিমাত্র-- ছন্দও তেমনি ভাঙা ভাঙা, ঠিক যেন হৃদয়ের পূর্ণ উচ্ছ্বাসের সময় সকল কথা ভালো করিয়া বাহির হইতেছে না। "সৈন্যদল যাইতেছে, পাখিরা গাইতেছে, ঝিল্লিরব হইতেছে, যুদ্ধাস্ত্রের শব্দ উঠিতেছে-- বর্মের উপর বর্শাঘাতের ধ্বনি হইতেছে। ওই উজ্জল চন্দ্র আকাশের তলে ভ্রমণ করিতে লাগিল। ভয়ানক দৃশ্যসকল দৃষ্টিগোচর হইল।... প্রাঙ্গণে যুদ্ধ-কোলাহল উত্থিত হইল। তাহারা কাষ্ঠের ঢাল হস্তে ধারণ করিল। তাহারা মস্তকের অস্থিভেদ করিয়া অস্ত্র বিদ্ধ করিল। দুর্গের ছাদ প্রতিধ্বনিত হইল।... অন্ধকারবর্ণ অশুভদর্শন কাকেরা চারি দিকে উইলোপত্রের ন্যায় উড়িয়া বেড়াইতে লাগিল।'

 

অ্যাংলো স্যাক্‌সন কবিতায় প্রেমের কথা নাই বলিলেও হয়; কিন্তু বন্ধুত্ব ও প্রভুপ্রীতির সুন্দর বর্ণনা আছে। "বৃদ্ধ রাজা তাঁহার সর্বশ্রেষ্ঠ অনুচরকে আলিঙ্গন করিলেন-- দুই হস্তে তাহার গলা জড়াইয়া ধরিলেন, বৃদ্ধ অধিপতির কপোল বাহিয়া অশ্রু প্রবাহিত হইল, সে বীর তাঁহার এত প্রিয় ছিল। তাঁহার হৃদয় হইতে যে অশ্রুধারা উত্থিত হইল তাহা নিবারণ করিলেন না! হৃদয়ে মর্মের গভীর তন্ত্রীতে তাঁহার প্রিয় বীরের জন্য গোপনে নিশ্বাস ফেলিলেন।'

 

কোনো দেশান্তরিত ব্যক্তি তাহার প্রভুকে স্বপ্নে দেখিতেছে-- যেন তাঁহাকে আলিঙ্গন, চুম্বন করিতেছে, যেন তাঁহার ক্রোড়ে মাথা রাখিতেছে। অবশেষে যখন জাগিয়া উঠিল, যখন দেখিল সে একাকী, যখন দেখিল সম্মুখে জনশূন্য প্রদেশ বিস্তীর্ণ, সামুদ্রিক পক্ষীরা পক্ষবিস্তার করিয়া তরঙ্গে ডুব দিতেছে, বরফ পড়িতেছে, তুষার জমিতেছে, শিলাবৃষ্টি হইতেছে, তখন সে কহিয়া উঠিল--

 

"কতদিন আনন্দের সহিত আমরা মনে করিয়াছিলাম যে, মৃত্যু ভিন্ন আর কিছুতেই আমাদিগকে বিচ্ছিন্ন করিতে পারিবে না, অবশেষে তাহা মিথ্যা হইল, যেন আমাদের মধ্যে কখনো বন্ধুত্ব ছিল না। কষ্ট দিবার জন্য মানুষেরা আমাকে এই অরণ্যে এক ওক্‌ বৃক্ষের তলে এই গহ্বরে বাস করিতে দিয়াছে। এই মৃত্তিকার নিবাস অতি শীতল, আমি শ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছি। গহ্বরসকল অন্ধকার, পর্বতসকল উচ্চ, কণ্টকময় শাখা-প্রশাখার নগর, এ কী নিরানন্দ আলয়!... আমার বন্ধুরা এখন ভূগর্ভে-- যাহাদের ভালোবাসিতাম, এখন কবর তাহাদিগকে ধারণ করিতেছে। কবর তাহাদের রক্ষা করিতেছে-- আর আমি একাকী ভ্রমিয়া বেড়াইতেছি। এই ওক্‌ বৃক্ষতলে এই গহ্বরে এই দীর্ঘ গ্রীষ্মকালে আমাকে বসিয়া থাকিতে হইবে।'

 

অ্যাংলো স্যাক্‌সন কবিতার ছন্দ বড়ো অদ্ভুত। ইহার মিল নাই বা অন্য কেনো নিয়ম নাই, কেবল প্রত্যেক দ্বিতীয় ছত্রে দুই-তিনটি এমন কথা থাকিবে যাহার প্রথম অক্ষর এক, যেমন--

 

Ne waes her tha giet, nym the heolstirsceado

Wiht geworden; ac thes wida grund

Stood deol and dim, drihtne fremde,

Idel and unnyt.

 

 

অ্যাংলো স্যাক্‌সন খৃস্টান কবিদিগের মধ্যে প্রধান ও প্রথম, কিডমন (Caedmon)। অনেক বয়স পর্যন্ত কিডমন কবিতা রচনা করিতে পারিতেন না। একদিন এক নিমন্ত্রণ সভায় সকলে বীণা লইয়া পর্যায়ক্রমে গান গাইতেছিল, কিডমন যেই দেখিলেন, তাঁহার কাছে বীণা আসিতেছে, অমনি আস্তে আস্তে সভা হইতে উঠিলেন এবং বাড়ি প্রস্থান করিলেন। একদিন রাত্রে এক অশ্বশালায় চৌকি দিতে দিতে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলেন, স্বপ্ন দেখিলেন একজন কে যেন আসিয়া তাঁহাকে কহিতেছে, "কিডমন, আমাকে একটা গান শুনাও!' কিডমন কহিলেন, "আমি যে গাইতে পারি না।' সে কহিল, "তাহা হউক, তুমি গাহিতে পারিবে।' কিডমন কহিলেন, "কী গান গাইব।' সে কহিল, "সৃষ্টির আরম্ভ বিষয়ে।' ঘুম ভাঙিয়া গেলে কিডমন আবেস্‌ হিলডার নিকট গিয়া সমস্ত বৃত্তান্ত কহিলেন; আবেস্‌ মনে করিলেন কিডমন দেবপ্রসাদ পাইয়াছেন, তিনি কিডমনকে তাঁহার দেবালয়ের সন্ন্যাসী-দলভুক্ত করিয়া লইলেন। কৃত্তিবাস যেমন কথকতা শুনিয়া রামায়ণ লিখিতেন, তেমনি একজন কিডমনকে বাইবেল অনুবাদ করিয়া শুনাইত আর তিনি তাহা ছন্দে পরিণত করিতেন। আমাদের দেশের কবিদের সহিত, কিডমনের স্বপ্ন-আদেশের বিষয় কেমন মিলিয়া গিয়াছে।

 

সৃষ্টির বিষয়ে কিডমন এইরূপ বর্ণনা করিয়াছেন--

 

                    গুহা-অন্ধকার ছাড়া ছিল না কিছুই!

                    এ মহা অতলস্পর্শ আঁধার গভীর--

                    আছিল দাঁড়ায়ে শুধু শূন্য নিষ্ফল।

                    উন্নত ঈশ্বর তবে দেখিলা চাহিয়া

                    এই নিরানন্দস্থান! দেখিলা হেথায়

                    অন্ধকার, বিষণ্ণ ও শূন্য মেঘরাশি

                    রহিয়াছে চিরস্থির-নিশীথিনী ল'য়ে।

                    উত্থিল হইল সৃষ্টি ঈশ্বর-আজ্ঞায়।

                    মহান ক্ষমতাবলে অনন্ত ঈশ্বর

                    প্রথমে স্বর্গ ও পৃথ্বী করিলা সৃজন।

                    নির্মিলা আকাশ; আর এ বিস্তৃত ভূমি

                    সর্বশক্তিমান প্রভু করিলা স্থাপন।

                    পৃথিবী তরুণ তৃণে ছিল না হরিত,

                    সমুদ্র চিরান্ধকারে আছিল আবৃত,

                    পথ ছিল সুদূর-বিস্তৃত, অন্ধকার!

                    আদেশিলা মহাদেব জ্যোতিরে আসিতে

                    এ মহা আঁধার স্থানে। মুহূর্তে অমনি--

                    ইচ্ছা পূর্ণ হল তাঁর। পবিত্র আলোক

                    এই মরুময় স্থানে পাইল প্রকাশ।

 

 

কিডমন ইজিপ্টের ফ্যারাওর (Pharaoh) যুদ্ধে মৃত্যুবর্ণনা করিতেছেন--

 

                    ভয়ে তাহাদের হৃদি হইল আকুল!

                    মৃত্যু হেরি সমুদ্র করিল আর্তনাদ,

                    পর্বত-শিখর রক্তে হইল রঞ্জিত,

                    সিন্ধু রক্তময় ফেন করিল উদ্‌গার,

                    উঠিল মৃত্যু-আঁধার, গর্জিল তরঙ্গ,

                    পলা'ল ইজিপ্টবাসী ভয়ে কম্পান্বিত!

                                    ...

                    সমুদ্র তরঙ্গরাশি মেঘের মতন

                    ধাইয়া তাদের পানে, পড়িল ঝাঁপিয়া;

                    গৃহে আর কাহারেও হল না ফিরিতে

                    যেথা যায় সেখানেই উন্মত্ত জলধি--

                    বিনষ্ট হইয়া গেল তাহাদের বল,

                    উঠিল ঝটিকা ঘোর আকাশ ব্যাপিয়া,

                    করিল সে শত্রুদল দারুণ চীৎকার!

                    মৃত্যুর নিদানে বায়ু হল ঘনীভূত!

 

 

পাঠকেরা যদি মিলটনের শয়তানের সহিত কিডমনের শয়তানের তুলনা করিয়া দেখেন তবে অনেক সাদৃশ্য পাইবেন।

 

                    কেন বা সেবিব তাঁরে প্রসাদের তরে?

                    কেন তাঁর কাছে হব দাসত্বে বিনত?

                    তাঁর মতো আমিও বিধাতা হতে পরি।

                    তবে শুন-- শুন সবে বীর-সঙ্গীগণ

                    তোমরা সকলে মোর করো সহায়তা,

                    তা হলে এ যুদ্ধে মোরা লভিব বিজয়!

                    সুবিখ্যাত, সুদৃঢ়-প্রকৃতি বীরগণ

                    আমারেই রাজা ব'লে করেছে গ্রহণ।

                    সুযুক্তি দিবার যোগ্য ইহারাই সবে,

                    যুঝিব ঈশ্বর সাথে ইহাদের লয়ে!

                                   ...

                    ইহাদেরি রাজা হয়ে শাসিব এ দেশ,

                    তবে কী কারণে হব তাঁহারি অধীন?

                    কখনো-- কখনো তাঁর হইব না দাস।

 

 

আর-এক স্থলে--

 

                    উচ্চ স্বর্গধামে মোরে করিলেন দান--

                    ঈশ্বর যে সুখ-ভূমি, সে স্থানের সাথে

                    এ সংকীর্ণ আবাসের কী ঘোর প্রভেদ।

                    যদি কিছুক্ষণ তরে পাই গো ক্ষমতা--

                    এক শীত ঋতু তরে হই মুক্ত যদি

                    তাহা হলে সঙ্গীগণ ল'য়ে-- কিন্তু হায়--

                    চারি দিকে রহিয়াছে লৌহের বাঁধন!

                    এই ঘোর নরকের দৃঢ়মুষ্টি মাঝে

                    কী দারুণরূপে আমি হয়েছি আবদ্ধ!

                    ঊর্ধ্বে, নিম্নে জ্বলিতেছে বিশাল অনল--

                    এমন জঘন্য দৃশ্য দেখি নি কখনো!

 

 

বীরের নৈরাশ্য সুন্দররূপে বর্ণিত হইয়াছে। অবশেষে শয়তান স্থির করিলেন যদি ঈশ্বর-সৃষ্ট মনুষ্যের কোনো অপকার করিতে পারেন তাহা হইলে তিনি "এই শৃঙ্খলের মধ্যে থাকিয়াও সুখে ঘুমাইবেন'।

 

ইতিমধ্যে ডেনিসরা একবার ইংলন্ড আক্রমণ করিয়াছিল; কিন্তু অ্যালফ্রেড তাহাদিগকে দমন করেন। নবম শতাব্দীতে অ্যালফ্রেডের রাজত্বকালে অ্যাংলো স্যাক্‌সন ভাষা ও সাহিত্য চরম উন্নত সীমায় পৌঁছিয়াছিল। অ্যালফ্রেডের এই একমাত্র বাসনা ছিল যে, যাহাতে "মৃত্যুর পর তিনি তাঁহার সৎকার্যের স্মরণচিহ্ন রাখিয়া যাইতে পারেন'। সে বিষয়ে তিনি কৃতকার্য হইয়াছিলেন। তিনি একজন বলবান যোদ্ধা ছিলেন, ও তখনকার ইংলন্ডের অন্যান্য রাজ্য অতিশয় বিশৃঙ্খল হইয়াছিল, ইচ্ছা করিলে হয়তো তিনি সমস্ত ইংলন্ড বশে আনিতে পারিতেন। কিন্তু সেদিকে তাঁহার অভিলাষ ধাবিত হয় নাই, শান্তিস্থাপনা, সুশাসন ও নিজ প্রজাদের মধ্যে সুশিক্ষা প্রচার করাই তাঁহার একমাত্র ব্রত ছিল। অ্যালফেডের যে অসাধারণ প্রতিভা বা উদ্‌ভাবনী শক্তি ছিল তাহা নহে, তাঁহার সৎ ইচ্ছা ও মহান অধ্যবসায় ছিল। তিনি তাঁহার উচ্চ আশা ও স্বার্থ পরিতৃপ্ত করিতে কিছুমাত্র মন দেন নাই, প্রজাদের মঙ্গলই তাঁহার জীবনের উদ্দেশ্য ছিল। তিনি দুঃখ করিয়া বলেন যে, এমন একদিন ছিল যখন বিদেশ হইতে লোকে ইংলন্ডে বিদ্যা শিখিতে আসিত, কিন্তু এখন বিদ্যা শিখিতে গেলে বিদেশীদের নিকট শিখিতে হয়। এই অজ্ঞতা দূর করিবার জন্য তিনি দেশীয় ভাষায় নানা পুস্তক অনুবাদ করিতে লাগিলেন। অ্যালফ্রেড যদিও অনেক লাটিন পুস্তক অনুবাদ করিয়াছিলেন তথাপি তাঁর লাটিন অতি অল্পই জানা ছিল; অতি প্রশংসনীয় সরলতার সহিত ইহা তিনি নিজেই স্বীকার করিয়াছেন : "যদি আমার চেয়ে কেহ অধিক লাটিন জান, তবে আমায় কেহ দোষ দিয়ো না, কারণ প্রত্যেক মনুষ্য তাহার যে পর্যন্ত ক্ষমতা আছে, সেই অনুসারেই কথা কহিবে ও কাজ করিবে।' তাঁহার অনুবাদের মধ্যে স্থানে স্থানে লাটিনের অজ্ঞতা স্পষ্ট প্রকাশ পাইয়াছে। অ্যালফ্রেডই অ্যাংলো স্যাক্‌সন ভাষায় গদ্যের প্রথম সৃষ্টিকর্তা। তখনকার অজ্ঞলোকদের বুঝাইবার জন্য তাঁহার অনুবাদ যথাসাধ্য সহজ করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, এক ছত্র ভাঙিতে গিয়া তাঁহাকে দশ ছত্র লিখিতে হইয়াছিল। ইঁহার সময় হইতেই ইংলন্ডের Chronicle অর্থাৎ ঐতিহাসিক বিবরণ লিখিত হয়। কিন্তু সে অতি শুষ্ক ও নীরস। তাহা ইতিহাসের কোনো উদ্দেশ্য সাধন করিতে পারে নাই। তাহাতে তখনকার ব্যক্তিদিগের অবস্থার বিষয় কিছুই বর্ণিত হয় নাই, কেবল অমুক বৎসরে দুর্ভিক্ষ হইল, অমুক বৎসরে অমুক নগরে আগুন লাগিল, অমুক বৎসরে একটা ধূমকেতু উঠিল, ইত্যাদি কতকগুলি ঘটনার বিবরণ মাত্র লিখিত আছে।

 

আবার ডেনিসরা ইংলন্ড আক্রমণ করে; এবার ইংলন্ড তাহাদের হস্তগত হইল। ডেনিসদের সহিত স্যাক্‌সনদের ভাষা ও আচার-ব্যবহারের বিশেষ কিছুই প্রভেদ ছিল না। কান্যুট প্রজাদের কীরূপ প্রিয়পাত্র হইয়াছিলেন, তাহা সকলেই জানেন। যাহা হউক, অ্যাংলো স্যাক্‌সন রাজত্বের শেষভাগে অ্যাংলো স্যাক্‌সন সাহিত্যের যথেষ্ট অবনতি হইয়া আসিয়াছিল। ধর্মাচার্যগণ অলস বিলাসী অজ্ঞ, সাধারণ লোকেরা নীতিভ্রষ্ট ও ধূর্ত হইয়া আসিতেছিল। এই সময় ইংলন্ডে নর্মান সভ্যতা-স্রোত প্রবেশ করিয়া দেশের ও ভাষার যথেষ্ট উন্নতি করিয়াছিল। যাহা হউক, ডেনিসরাজ্য শীঘ্রই বিলুপ্ত হইল।

 

খৃস্টীয় ধর্ম প্রবেশ করিলে পর ইংরাজি ভাষায় অনেক রোমীয় কথা প্রবেশ করে। কিন্তু নর্মান অধিকারের সময়েই অধিকাংশ লাটিন-ধাতুজাত কথা ইংরাজি ভাষায় প্রচলিত হয়। অনেক ডেনিস কথা ইংরাজিতে পাওয়া যায়।

 

যখন স্যাক্‌সনেরা তাহাদের আদিম দেশে ছিল তখন তাহাদের স্বভাব কীরূপ ছিল তাহা বর্ণনা করিয়াছি। যখন ইংলন্ডে আসিয়া তাহারা একটা স্থায়ী বাসস্থান পাইল, তখন তাহাদের বিলাসের দিকে দৃষ্টি পড়িল। কিন্তু সে কীরূপ বিলাস? মুসলমানেরা ভারতবর্ষে আসিয়া যেরূপ বিলাসে মগ্ন হইয়াছিল, ইহা সে বিলাস নহে। যে বিলাসের সহিত সুকুমার বিদ্যার সংস্রব আছে, ইহা সে বিলাস নহে। অ্যাংলো স্যাক্‌সেনদের শিল্প দেখো, নাই বলিলেও হয়; তাহাদের কবিতা দেখো, কেবল রক্তময়। কবিতার যে অংশের সহিত শিল্পের যোগ আছে-- ছন্দ, তাহা স্যাক্‌সন ভাষায় অতি বিশৃঙ্খল। লাটিন সাহিত্যের আদর্শ পাইয়াও তাহাদের কবিতার ও ছন্দের বিশেষ কিছুই উন্নতি হয় নাই। স্যাক্‌সনদের হৃদয়ে সুন্দর-ভাবের আদর্শ ছিল না বলিয়াই মনে হয়-- তাহাদের বিলাস আর কী হইতে পারে? আহার ও পান। সমস্ত দিনরাত্রি পানভোজনেই মত্ত থাকিত। এড্‌গারের সময় ধর্মমন্দিরে অর্ধরাত্রি পর্যন্ত নাচ গান পান ভোজন চলিত। পৃথিবীর প্রথম যুগের অসহায় অবস্থার সহিত যুদ্ধ করিয়া একটু অবসর পাইলেই, আর্যেরা (আর্যেরা বলিলে যদি অতি বিস্তৃত অর্থ বুঝায় তবে হিন্দুরা) স্বভাবতই জ্ঞান উপার্জনের দিকে মনোযোগ দিতেন, কিন্তু স্যাক্‌সনেরা তাহাদের অবসরকাল অতিবাহিত করিবার জন্য অদ্ভুত উপায় বাহির করিয়াছিল; সে উপায়টি-- দিনরাত্রি অজ্ঞান হইয়া থাকা। তাহারা উত্তেজনা চায়, তাহারা ঋষিদের মতো অমন বিজনে বসিয়া ভাবিতে পারে না-- অসভ্য সংগীত উচ্চৈঃস্বরে গাইয়া, যুদ্ধের নৃশংস আমোদে উন্মত্ত থাকিয়া তাহারা দিন যাপন করিতে চায়। রক্তপাত ও লুটপাট ছাড়া আর কথা ছিল না। দাস ব্যবসায় যদিও আইনে বারণ ছিল, কিন্তু সে বারণে কেনো কাজ হয় নাই-- নর্মান রাজত্ব সময়ে দাস ব্যবসায় উঠিয়া যায়। গর্ভবতী দাসীদিগের মূল্য অনেক বলিয়া তাহারা স্ত্রী দাসীদিগের প্রতি জঘন্য আচরণ করিত। তবুও খৃস্টধর্ম ইহাদের অনেকটা নরম করিয়া আনিয়াছিল। স্যাক্‌সনদের বুদ্ধি তখন তীব্র নহে। তাহাদের মধ্যে প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি অতি অল্পই জন্মিয়াছে। তাহাদের কবিতার উপাখ্যানসমূহের ভালোরূপ ধারাবাহিক যোগ নাই, তাহাদের কবিদের ঔপন্যাসিক ক্ষমতা তেমন ছিল না। স্যাক্‌সনদের মধ্যে বিদ্যা-প্রচার করিবার জন্য অনেকবার চেষ্টা করা হইয়াছিল, কিন্তু সে বিষয়ে কেহই কৃতকার্য হয় নাই। স্যাক্‌সন ধর্মাচার্যদের মধ্যে যে বিদ্যাচর্চার আরম্ভ হয় তাহা কয়েক শতাব্দী মাত্র থাকে, তাহার পরেই আবার সমস্ত অন্তর্হিত হইয়া যায়। নর্মানরা আসিয়া স্যাক্‌সন খৃস্ট-পুরোহিতদিগের অজ্ঞতা দেখিয়া অতিশয় বিরক্ত হয়। অ্যাংলো স্যাক্‌সন সাহিত্য অতি সামান্য। অ্যালফ্রেডের গদ্যগ্রন্থ ও বোউল্‌ফ এবং অন্যান্য দুই-একটি কবিতা লইয়াই তাহাদের সাহিত্যের যথা-সর্বস্ব।

 

স্বাধীনতা-প্রিয়তা ও বীরত্ব স্যাক্‌সন জাতীয়দিগের প্রধান গুণ। তাহাদের সমস্ত স্বভাব পৌরুষেই গঠিত। সকলেই আপনার আপনার প্রভু। রাজার সহিত প্রজার তেমন প্রভেদ ছিল না-- স্যাক্‌সন রাজ্যের শেষাশেষি সেই প্রভেদ জন্মে। জর্মনিতে ভীরুদিগকে পঙ্কে পুঁতিয়া বিনষ্ট করিত। স্যাক্‌সনেরা যাহাকে প্রধান বলিয়া মানে তাহার জন্য সকলই করিতে পারে। যে তাহার প্রধানকে না লইয়া যুদ্ধক্ষেত্র হইতে প্রত্যাবর্তন করে, তাহার বড়ো অখ্যাতি। যে প্রধানের গৃহে তাহারা মদ্যপান করিয়াছে, যাহার নিকট হইতে বিশ্বাসের চিহ্ন তরবারি ও বর্ম পাইয়াছে তাহার জন্য প্রাণদান করিতে তাহারা কাতর নহে-- এ ভাব তাহাদের কবিতার যেখানে-সেখানে প্রকাশ পাইয়াছে। স্যাক্‌সন জাতিদের কল্পনা ও সৌন্দর্য-প্রীতি ছিল না, তাহাদের চরিত্রে কার্যকরী বুদ্ধি ও পৌরুষ অতিমাত্র ছিল।

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •