শরৎচন্দ্র (sharatchandra )

নর্মাল স্কুলে সীতার বনবাস পড়া শেষ হল। সমাসদর্পণ ও লোহারামের ব্যাকরণের যোগে তার পরীক্ষাও দিয়েছি। পাস করে থাকব কিন্তু পারিতোষিক পাই নি। যাঁরা পেয়েছিলেন তাঁরা সওদাগরি আপিস পার হয়ে আজ পেনসন ভোগ করছেন।

 

এমন সময় বঙ্গদর্শন বাহির হল। তাতে নানা বিষয়ে নানা প্রবন্ধ বেরিয়েছিল--তখনকার মননশীল পাঠকেরা আশা করি তার মর্যাদা বুঝেছিলেন। তাঁদের সংখ্যা এখনকার চেয়ে তখন যে বেশি ছিল তা নয়, কিন্তু প্রভেদ এই যে, তখনকার পাঠকেরা এখনকার মতো এত বেশি প্রশ্রয় পান নি। মাসিক পত্রিকা, বলতে গেলে, ওই একখানিই ছিল। কাজেই সাধারণ পাঠকের মুখরোচক সামগ্রীর বরাদ্দ অপরিমিত ছিল না। তাই পড়বার মনটা অতিমাত্র বিলাসী হয়ে যায় নি। সামনে পাত সাজিয়ে যা-কিছু দেওয়া যেত তার কিছুই প্রায় ফেলা যেত না। পাঠকদের আপন ফরমাসের জোর তখন ছিল না বললেই হয়।

 

কিন্তু রসের এই তৃপ্তি রসদের বিরলতাবশতই এটা বেশি বলা হল। বঙ্গদর্শনের প্রাঙ্গণে পাঠকেরা যে এই বেশি ভিড় করে এল, তার প্রধান কারণ, ওর ভাষাতে তাদের ডাক দিয়েছিল। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রথম আবির্ভাব ওই পত্রিকায়। এর পূর্বে বাঙালির আপন মনের ভাষা সাহিত্যে স্থান পায় নি। অর্থাৎ ভাষার দিক থেকে দেখলে তখন সাহিত্য ছিল ভাসুরের বৈঠক, ভাদ্রবৌ ঘোমটা টেনে তাকে দূরে বাঁচিয়ে চলত, তার জায়গা ছিল অন্দর মহলে। বাংলা দেশে স্ত্রীস্বাধীনতা যেমন ঘেরাটোপ ঢাকা পাল্কি থেকে অল্পে অল্পে বেরিয়ে আসছে ভাষার স্বাধীনতাও তেমনি। বঙ্গদর্শনে সব-প্রথম ঘেরাটোপ তোলা হয়েছিল। তখনকার সাহিত্যিক স্মার্ত পণ্ডিতেরা সেই দুঃসাহসকে গঞ্জনা দিয়ে তাকে গুরুচণ্ডালি ব'লে জাতে ঠেলবার চেষ্টায় ছিলেন। কিন্তু পাল্কির দরজার ফাঁক দিয়ে সেই যে বাংলা ভাষার সহাস্য মুখ প্রথম একটুখানি দেখা গেল, তাতে ধিক্‌কার যতই উঠুক এক মুহূর্তেই বাঙালি পাঠকের মন ভুলেছিল। তার পর থেকে দরজা ফাঁক হয়েই চলেছে।

 

প্রবন্ধের কথা থাক্‌। বঙ্গদর্শনে যে জিনিসটা সেদিন বাংলা দেশের ঘরে ঘরে সকলের মনকে নাড়া দিয়েছিল সে হচ্ছে বিষবৃক্ষ। এর পূর্বে বঙ্কিমচন্দ্রের লেখনী থেকে দুর্গেশনন্দিনী কপালকুণ্ডলা মৃণালিনী লেখা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলি ছিল কাহিনী। ইংরেজিতে যাকে বলে রোম্যান্স। আমাদের প্রতিদিনের জীবযাত্রা থেকে দূরে এদের ভূমিকা। সেই দূরত্বই এদের মুখ্য উপকরণ। যেমন, দূরদিগন্তের নীলিমায় অরণ্য-পর্বতকে একটা অস্পষ্টতার অপ্রাকৃত সৌন্দর্য দেয় এও তেমনি। সেই দৃশ্যছবির প্রধান গুণ হচ্ছে তার রেখার সুষমা, অন্য পরিচয় নয়, কেবল তার সমগ্র ছন্দের ভঙ্গিমা। দুর্গেশনন্দিনী কপালকুণ্ডলা মৃণালিনীতে সেই রূপের কুহক আছে। তা যদি রঙিন কুহেলিকয়া রচিত হয় তবুও তার রস আছে।

 

কিন্তু নদী গ্রাম প্রান্তরের ছবি আর সূর্যাস্তকালের রঙিন মেঘের ছবি এক দামের জিনিস নয়। সৌন্দর্যলোক থেকে এদের কাউকেই বর্জন করা চলে না, তবু বলতে হবে ওই জনপদের চেহারায় আমাদের তৃপ্তির পূর্ণতা বেশি। উপন্যাসে কাহিনী ও কথা উভয়ের সামঞ্জস্য থাকলে ভালো-- নাও যদি থাকে তবে বস্তুপদার্থটার অভাব ঘটলে দুধ খেতে গিয়ে শুধু ফেনাটাই মুখে ঠেকে, তার উচ্ছ্বাসটা চোখে দেখতে মানায়, কিন্তু সেটা ভোগে লাগে না।

 

বঙ্কিমচন্দ্রের গোড়ার দিকের তিনটে কাহিনী যেন দৃঢ় অবলম্বন পায় নি-- তাদের সাজসজ্জা আছে, কিন্তু পরিচয়পত্র নেই। তারা ইতিহাসের ভাঙা ভেলা আঁকড়ে ভেসে এসেছে। তাদের বিনা তর্কে মেনে নিতে হয়, কেননা, তারা বর্তমানের সামগ্রী নয়, তারা যে-অতীতে বিরাজ করে, সে-অতীতকে ইতিহাসের আদর্শেও সওয়াল-জবাব করা চলে না, আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতার আদর্শেও নয়। সেখানে বিমলা আয়েষা জগৎসিংহ কপালকুণ্ডলা নবকুমার প্রভৃতিরা যা-খুশি তাই করতে পারে কেবল তাদের এইটুকু বাঁচিয়ে চলতে হয় যে, পাঠকদের মনোরঞ্জনে ত্রুটি না ঘটে।

 

আরব্য উপন্যাসও কাহিনী, কিন্তু সে হল বিশুদ্ধ কাহিনী। সম্ভবপরতার জবাবদিহি তার একেবারেই নেই। জাদুকর গোড়া থেকে স্পষ্ট করেই বলেছে, এ আমার অসম্ভবের ইন্দ্রজাল, সত্য মিথ্যা যাচাই করার দায় সম্পূর্ণ ঘুচিয়ে দিয়ে আমি তোমাদের খুশি করব-- যেখানে সবই ঘটতে পারে সেখানে এমন কিছু ঘটাব, যাতে তোমরা শাহারজাদীকে বলবে, থেমো না, রাত্রের পর রাত্রি যাবে কেটে। কিন্তু যে-সব কাহিনীর কথা পূর্বে বলেছি সেগুলি দো-আঁস্‌লা, তারা খুশি করতে চায়, সেইসঙ্গে খানিকটা বিশ্বাস করাতেও চায়। বিশ্বাস করতে পারলে মন যে নির্ভর পায় তার একটি গভীর আরাম আছে। কিন্তু যে-গল্পগুলি বিশুদ্ধ কাহিনী নয় কাহিনীপ্রায়, তাদের মধ্যে মনটা ডুব-জলে সঞ্চরণ করে, তলায় কোথাও মাটি আছে কি নেই সে কথাটা স্পষ্ট হয় না, ধরে নিই যে মাটি আছে বৈকি।

 

বিষবৃক্ষে কাহিনী এসে পৌঁছল আখ্যানে। যে-পরিচয় নিয়ে সে এল তা আছে আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে। সাহিত্য থেকে অস্পষ্টতার আবরণ এক পর্দা উঠে গেল--ক্লাসিকাল অস্পষ্টতা বা রোম্যান্টিক অস্পষ্টতা অর্থাৎ ধ্রুপদী বা খেয়ালি দূরত্ব, সীতার বনবাসের ছাঁদ বা রাজপুতকাহিনীর ছাঁদ। মনে পড়ে আমার অল্প বয়সের কথা। তখন চোখে কম দেখতুম অথচ জানতুম না যে কম দেখি। ওই কম দেখাটাকেই স্বাভাবিক বলে জানতুম, কোনো নালিশ ছিল না। এমন সময় হঠাৎ চশমা পরে জগৎটা যখন স্পষ্টতর হল তখন ভারি আনন্দ পেলুম। বিজয়বসন্তেও একদিন বাঙালি পাঠক সন্তুষ্ট ছিল, তখন সে জানত না গল্পে এর চেয়ে স্পষ্টতর জগৎ আছে। তার পরে দুর্গেশনন্দিনীতে চমক লাগল, এটা তার কাছে অভূতপূর্ব দান। কিন্তু তখনো ঠিক চশমাটি সে পায় নি, তবু দুঃখ ছিল না, কেননা, জানত না যে সে পায় নি। এমন সময়েই বিষবৃক্ষ দেখা দিল। কৃষ্ণকান্তের উইল সেই জাতেরই, সে যেন আরো স্পষ্ট।

 

তার পরে এলেন প্রচারক বঙ্কিম। আনন্দমঠ, দেবীচৌধুরানী, সীতারাম, একে একে আসরে এসে উপস্থিত, গল্প বলবার জন্যে নয়, উপদেশ দেবার জন্যে। আবার অস্পষ্টতা সাধু অভিপ্রায়ের গৌরবগর্বে সাহিত্যে উচ্চ আসন অধিকার করে বসল।

 

আনন্দমঠ আদর পেয়েছিল। কিন্তু সাহিত্যরসের আদর সে নয়, দেশাভিমানের। এক-এক সময়ে জনসাধারণের মন যখন রাষ্ট্রিক বা সামাজিক বা ধর্মসাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় বিচলিত হয়ে থাকে সেই সময়টা সাহিত্যের পক্ষে দুর্যোগের সময়। তখন পাঠকের মন অল্পেই ভোলানো চলে। শুঁট্‌কি মাছের প্রতি আসক্তি যদি অত্যন্ত বেশি হয় তা হলে রাঁধবার নৈপুণ্য অনাবশ্যক হয়ে ওঠে। ওই জিনিসটার গন্ধ থাকলেই তরকারির আর অনাদর ঘটে না। সাময়িক সমস্যা এবং চল্‌তি সেন্টিমেন্ট, সাহিত্যের পক্ষে কচুরিপানার মতোই, তাদের জন্যে আবাদের প্রয়োজন হয় না, রসের স্রোতকে আপন জোরেই আচ্ছন্ন করে দেয়।

 

আধুনিক য়ুরোপে এই দশা ঘটেছে-- সেখানে আর্থিক সমস্যা, স্ত্রী-পুরুষের সমস্যা, বিজ্ঞান ও ধর্মের দ্বন্দ্ব-সমস্যায় সমাজে একটা বিপর্যয় কাণ্ড চলছে। লোকের মন তাতে এত বেশি প্রবলভাবে ব্যাপৃত যে, সাহিত্যে তাদের অনধিকারপ্রবেশ ঠেকিয়ে রাখা দায়, নভেলগুলি গল্পের মালমসলামাখা প্রবন্ধ হয়ে উঠল। এতে করে সাহিত্যে যে স্তূপাকার আবর্জনা জমে উঠেছে সেটা আজকের পাঠকদের উপলব্ধিতে পৌঁচচ্ছে না, কেননা, আজ সাহিত্যের বাহিরের মাল নিয়ে তাদের মন ষোলো-আনা ভর্তি হয়ে রয়েছে। আর-এক যুগে এই-সব আবর্জনা বিদায় করবার জন্যে গাড়িতে যমের বাহন মহিষ অনেকগুলো জুৎতে হবে।

 

আমার বক্তব্য এই যে আর্টিস্টের, সাহিত্যিকের প্রধান কাজ হচ্ছে দেখানো, বিশ্বরসের পরিচয়ে আবরণ যত কিছু আছে তাকে অপসারণ করা। রসের জগৎকে স্পষ্ট করে মানুষের কাছে এনে দেওয়া, মানুষের একান্ত আপন করে তোলা। সীতার বনবাস ইস্কুলে পড়েছিলাম। সেটা ইস্কুলের সামগ্রী। বিষবৃক্ষ পড়েছিলুম ঘরে, সেটা ঘরেরই জিনিস। সাহিত্যটা ইস্কুলের নয়-- ওটা ঘরের। বিশ্বে আত্মীয়তা ঘনিষ্ঠ করবার জন্যেই সাহিত্য।

 

বিষবৃক্ষের পর কৃষ্ণকান্তের উইলের পর অনেক দিন কেটে গেল। আবার দেখি গল্প-সাহিত্যে আর-একটা যুগ এসেছে। অর্থাৎ আরো একটা পর্দা উঠল। সেদিন যেমন ভিড় করে রবাহূতের দল জুটেছিল সাহিত্যের প্রাঙ্গণে আজও তেমনি জুটেছে। তেমনি উৎসাহ, তেমনি আনন্দ, তেমনি জনতা। এবারে নিমন্ত্রণকর্তা শরৎচন্দ্র। তাঁর গল্পে যে-রসকে তিনি নিবিড় করে জুগিয়েছেন সে হচ্ছে সুপরিচয়ের রস। তাঁর সৃষ্টি পূর্বের চেয়ে পাঠকের আরো অনেক কাছে এসে পৌঁছল। তিনি নিজে দেখেছেন বিস্তৃত করে, স্পষ্ট করে, দেখিয়েছেন তেমনি সুগোচর ক'রে। তিনি রঙ্গমঞ্চের পট উঠিয়ে দিয়ে বাঙালি সংসারের যে আলোকিত দৃশ্য উদ্‌ঘাটিত করেছেন সেইখানে আধুনিক লেখকদের প্রবেশ সহজ হল। তাদের আনাগোনাও চলছে। একদিন তারা হয়তো সে কথা ভুলবে এবং তাকে স্বীকার করতে চাইবে না। কিন্তু আশা করি পাঠকেরা ভুলবে না। যদি ভোলে সেটা তাদের অকৃতজ্ঞতা হবে। তাও যদি হয় তাতে দুঃখ নেই; কাজ সমাপ্ত হয়ে গেলে সেই যথেষ্ট। কৃতজ্ঞতাটা উপরি-পাওনা মাত্র; না জুটলেও নালিশ না করাই ভালো। নালিশের সময়ও বেশি থাকে না, কারণ সব শেষে যাঁর পালা তিনি যদি-বা দলিলগুলোকে রক্ষা করেন স্বত্বাধিকারীকে পার ক'রে দেন বৈতরণীর ওপারে।

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

Rendition

Please Login first to submit a rendition. Click here for help.